Thursday, May 14, 2020

বৈশ্বিক সংকট এবং সমাধান ভাবনা - ভূবন মুন্সী


সামগ্রিক পৃথিবী দেখার প্রশ্নে মগজ মর্টগেজ রাখলে চলবে না।
.........................................................................................


পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল, আর স্থলের সবটা করোনার আশ্রম!


বিশ্বায়নের এ যুগে ভাইরাস যে রকোটক গতিতে ছড়িয়ে পড়লো সারা বিশ্বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহামারি না ছড়ানোর জন্য ‘কোয়ারিন্টিন’ এবং ‘লক-ডাউন’ পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। প্রতিকারের জন্যও কোন সুসংবাদ খুব দ্রুতই শোনবো, এমনটা আশা করতেই পারি বিশ্বস্থ বিজ্ঞানের কাছে। আর তথ্যের আদান প্রদান, বিশ্লেষন করে আমরা মহামারীকে রুখতে পারবো এটাও আশা রাখি।

ইয়োভাল নোয়াহ হারারির কাছ থেকে জানি, “এইডস কিংবা ইবোলার মতো ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলেও ইতিহাসের অন্য যে কোন মহামারীর তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসব ভাইরাসজনিত মহামারী অনেক কম সংখ্যক মানুষের প্রাণনাশ করতে পেরেছে। এর কারণ, জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের মূল প্রতিরক্ষাটা হয়ে উঠেছে তথ্য বিনিময়, পৃথক থাকা নয়। মানবজাতি মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় অব্যাহত রেখেছে, এর কারণ, জীবাণু বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা জীবাণুর অন্ধ পরিব্যাপ্তির উপর নির্ভর না করে নির্ভর করছেন তথ্য-উপাত্তের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর।”৩

পুরনো রথ এখনো পিছনে টেনে ধরে আমাদের। এখনো কিছু বন্ধাত্ব্যে দীর্ণ মানুষ প্রস্তুত হয়ে থাকে সভ্যতার সম্মুখগামী রথটাকে পিছনে টেনে ধরার জন্য। এখনো মন্ত্র, ওঝা, তাবিজ, কবজ, মল-মুত্র দিয়ে সমস্যার চাকু রুখতে চায়। “আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত এসব রোগের জন্য মানুষ দায়ী করত ক্ষুব্ধ প্রভু, হিংসুটে শয়তান কিংবা দূষিত বায়ুকে। কিন্তু কোন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে তারা সন্দেহ করত না। মানুষ তখন বিশ্বাস করত, জ্বীন-পরীর উপস্থিতিতে এসব ঘটছে। কিন্তু তারা ভাবতেই পারত না একফোঁটা পানির মধ্যে থাকতে পার প্রাণসংহারক জীবাণুর বহর। সে-কারণে যখন ‘ব্ল্যাক ডেথ’ কিংবা গুটিবসন্ত আক্রমণ করত, তখন কতৃপক্ষ সর্বোচ্চ যে ব্যবস্থা নিত তাহল, বিভিন্ন প্রভু কিংবা সাধকের উদ্দেশ্যে গণপ্রার্থনার আয়োজন করত। এতে কোন লাভ হত না। বরং গণজমায়েতের ফলে আরো অনেক বেশি মানুষ সংক্রমণের শিকার হত।”৪. “বুজুক্খোর-ই বুড়ো ভীমরতি ছিলো আছে থাকবে”৫. তবে অধিকাংশ মানুষে এটা আজ প্রতিষ্ঠিত, “কোন ধর্মীয়, অধর্মীয়, প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে এই মহামারীকে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বানের জলের মতো সবার ঘরেই ঢুকে পড়ছে ভাইরাস আতঙ্ক। স্রষ্টার কাছে মুক্তি চেয়ে সাময়িক মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমলেও শেষ ভরসায় রাষ্ট্রগুলো তাকিয়ে আছে সাইন্স-ল্যাবরেটরি গুলোর দিকে।”৬

মানবাজাতি আজ শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসেই আক্রান্ত নয়, তারা আজ নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের ভয়াবহতারও শিকার। একটা মহামারির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে জনগণের উচিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে বিশ্বাস করা। নাগরিকদের উচিত তাদের সরকার ও কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করা এবং রাষ্ট্রের উচিত একে অপরকে বিশ্বাস করা। গত কয়েক বছর ধরেই দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা সুচিন্তিতভাবেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষ, জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বকে হেয় করে আসছেন। ফলস্বরূপ, আমরা এই ক্রান্তিকালটা পার করছি কোন নেতৃত্ব ছাড়াই।”৭.  সত্যিকার অর্থে নায়ক গণই  তো দেশ চালাচ্ছেন। নেতৃত্ব নেই এ কথা সত্যি হলো কি! তবে মহাশয় যা বুঝাতে চাচ্ছেন, তাতে মনে হলো তিনি আরও যোগ্য কোন নেতৃত্বের কথা বলছেন, যারা হবে হয়তো সৎ, মানব দরদী, দেশ প্রেমিক ইত্যাদি। কিন্তু দেশে দেশে সৎ, মহৎ নায়কদের মসনদে বসিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান দিতে পারবে? অধ্যাপক হারারি বিশ্বায়নের সমস্যা সমাধানের জন্য, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থের জন্য আমেরিকার এগিয়ে আসা বা পিছিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন, বা অন্য কেউ (আমেরিকার মতো স্বঘোষিত মোড়ল) এসে সে স্থান পূরণ করুক সে প্রত্যাশা রাখছেন।

স্বর্ণের দর পতন, শেয়ার বাজারের সূচক নিম্নগামী। করোনা আক্রমনের সাথে সাথে অর্থনীতির দেশে সংকটের জন্ম হয়েছে। লক ডাউন মেরে ভাইরাসের লাগাম টেনে ধরা গেলেও, লক ডাউন শেষে অর্থনীতির ঘোড়াতে লাগাম পরাতে বেগ পেতে হবে। অর্থবাদী ঝোঁকের কারণেই তো সভ্যতার চলতি ঘোড়া খাদে পড়ে রয়েছে।

দ্রষ্টব্য এই, “ পল ক্রগম্যান, যিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ভূগোল গবেষণা সমন্বিত করা কিংবা মার্কিন রাজনীতির মধ্য থেকে বিশ্বায়নের বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষেণ করারর অবকাশ থেকেই হোক, স্পষ্ট ভাবেই প্রচলিত মার্কিন বিধি বিধনি গুলো সংস্কারসহ অর্থনীতিকে রাজনীতির অনুসারণকারী হিসেবে দেখিয়েছেন অর্থাৎ অর্থনীতির আগে রাজনীতিকে স্থাপন করেছেন, সেই তিনিও কিন্তু বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে বৈশ্বিক কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রুপকল্পের কথা বলেননি। পাশ্চাত্য আজ আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সাংস্কৃতিক বা বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেও অর্থবাদী প্রবণতা দ্বারা আক্রান্ত।”৮

মহামতি কার্ল মার্ক্স যন্ত্রের অভিঘাত দেখলেও অর্থবাদী ঝোঁকের কারণে দার্শনিক চোখে বুঝে উঠতে পারেননি,৯, পল ক্রগম্যান অর্থনীতিকে রাজনীতির অনুসারণকারী হিসেবে দেখিয়েও, বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে বৈশ্বিক কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রুপকল্পের কথা বলতে পারেননি, অধ্যাপক হারিরি মহোদয়ও বিশ্বায়নের অনেক বিশ্লেষণ দিয়েও অবিশ্বায়িত কোন মোড়লের কাছ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না। সেলুকাস!!

আজ সংকট কোন দেশ সীমানায় আবদ্ধ- তা কিন্তু নয়, এটা আজ বৈশ্বিক। সমগ্র দুনিয়া অস্থিরতায় টালমাটাল; সংঘাত, দ্বন্ধ, খুন, ধর্ষন আর আত্মহত্যার প্রবল প্রতাপ সামাজিক চরাচরে, সব সমস্যা কিন্তু জাত, বর্ণ, ধনী, নির্ধনী বিচার করেবনা (যে কারো ঘরে, যে কোন দিন ঢুকে যেতে পারে)। একক বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া সব কিছুকে ট্যাকেল করা ব্যাক্তি নায়কদের পক্ষে সম্ভব কি?

প্রাযুক্তিক বিকাশে এটা আজ স্পষ্ট সমগ্র মানুষের জন্য একটিই পৃথিবী, লাব্ববাইক কন্ঠের অধিকারী শুধুই মানুষ, নষ্টকে নষ্ট বলার বোধ কিংবা মানিনা বলতে পারা অথবা সুন্দরকে ধারন করা বা নতুনকে মেনে চলার সক্ষমতা শুধুই মানুষের।

নষ্ট সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার দায় কিংবা যথার্থ সূর্যটাকে খুঁজে এনে ভোর উঠাবার বীরত্ব শুধুই মানুষের।

ভালোটা তরঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে যায় সমগ্র ভুবন, তেমনি মন্দটা বিষ হয়ে বিষিয়ে দেয় সবার যাপন। বেঁচে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার একটিই কিশতি আজ, ভালো বা মন্দ সবটা সবার সাথে একাকার।

মহাবিশ্বের এই সবুজ কিশতিতে অখন্ড মানবিক বোধে আমরা হয়ে উঠি একজন- ইউনিটি অব ম্যান।প্রত্যহ খুঁজে আনি যথার্থ সুন্দর, যথার্থ সূর্য সকাল।

২১.০৩.২০২০
এডিট-১৪.০৫.২০২০

তথ্যসূত্রঃ
১. কহতব্য।
২. worldometer.
৩. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৪. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৫. দুঃখ দহিত মুখ।
৬. মা-নু-ষ পেজ হতে।
৭. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৮. কহতব্য।
৯. মার্ক্স ও এঙ্গেলস

No comments:

Post a Comment