Saturday, May 16, 2020

কোন পথে পৃথিবী? ভূবন মুন্সী



এ এক বাইবেলিক সংকট! পথ জানা নাই। ৭.৮ বিলিয়ন মানুষ পথহীনতায় ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিচ্ছেন। দার্শনিকগণ সম্ভাব্য পথ ও পরিণতি বাতলে দিচ্ছেন। রাষ্ট্র নেতারাও আশা নিরাশার দোলাচালে জনগনকে আশ্বস্থ করছেন। ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল- সবার উৎসুক চোখ এখন COVID- 19 এ। অন্তত বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গন, ১ম ও ২য় বিশ্ব যুদ্ধ- এসবে মানুষের চোখ আজকের মতো ব্যাপক ব্যাপ্তিতে উৎসুক ছিলোনা। টুইন টাওয়ার হামলা, আফগানিস্তান - ইরাক -  লিবিয়া হামলা কিংবা লাদেন - সাদ্দাম - গাদ্দাফি সবটা মিলিয়েও মানুষের চোখে এতোটা উৎকন্ঠা জেগে ওঠেনি। এটা প্রভাব ও প্রায়োগিকতায় এবং মাত্রা ও গভীরতায় একদম ভিন্ন, নতুন- রিখটার স্কেলে এর কম্পন মাত্রা দশোর্ধ্ব; সুনামির চেয়েও প্রবল ঝাঁকুনি দিচ্ছে।


এটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সবলতা- দূর্বলতা সমুহ ওপেন করে দিচ্ছে এবং সমাজ মননের গভীরতর আকুতিকে আরো অধিক স্পষ্টতায় নিরীক্ষণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

আমরা জানি, প্রত্যেক সংকটই বেশ কিছু স্থায়ী এবং অস্থায়ী পরিবর্তন সাধন করে। তড়িঘড়ি করে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়- অনেকটা জরুরী অবস্থা জারী করে কেন্দ্র কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের মতো। জনগনও মেনে নেয় - তাদের মনোযোগ সন্নিবিষ্ট থাকে মহামরীতে বা এ সিদ্ধান্ত হয়তো সংকট উৎরে দেবে- এ আশ্বাসে। এমন পরিস্থিতি রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারী স্বভাবকে আরো সংহত করে।

সংকটকালীন সময়ে (crisis moment) গৃহীত সিদ্ধান্তসমুহ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক অবস্থায় তা গনবিরোধী, স্বৈরাচারী, শোষণমূলক সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। রাষ্ট্রও সেখান থেকে বেরিয়ে না এসে বরং সে সিদ্ধান্তকেই সর্বদার জন্য যুক্তিযুক্ত গণ্য করে সচল রাখতে থাকে। অন্তত আমরা এটুকু জানি, আপদকালীন সিদ্ধান্ত সমূহ গ্যাটিসমারা সল্যুশন হয়ে থাকে কিংবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাকারণিক সমাধান (grammatical solution) এড়িয়ে যাওয়া হয়।

ব্যাকারণিক সমাধান- এটা বিদ্যমান সংকটের উৎসমূল খোঁজে বের করে। রাষ্ট্রিক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট সমূহের মূলোৎপাটন করতে সচেষ্ট থাকে। শুধু আজকের করোনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলমান জলবায়ু সমস্যা কিংবা আর্থিক মন্দা অথবা সামজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান নৈতিক ধ্বস, অবক্ষয়, অস্থিরতা - যা মানুষকে আরও অধিক বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বা জীবনের প্রতি বিপন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি জাগিয়ে তুলে মানুষকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করছে - এসব সমস্যা কোন ভাবেই ব্যাকারণিক বা দর্শনগত দিশা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।  এ দিশা যেমন দেশজ, সেই সাথে বৈশ্বকতাকে ধারণ করে হতে হবে। কোন মানুষ কিংবা কোন রাষ্ট্রই আজ আর বিচ্ছিন্ন নয় এবং তাদের সমস্যাগুলোও। প্রযুক্তির উল্লম্ফনে বিশ্ব এখন গাঁয়ের চেয়েও ছোট।

মহামারীর এ কালে আমরা রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্পনে চোখ রাখতে পারি।

রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে দেখবো- দায় দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের যোজন বিয়োজন শেষে রাষ্ট্র সমুহের কপালে ব্যার্থ রাষ্ট্রের কালো টিপ সেঁটে দেওয়া যায়। খুব জোরেশোরে এবং বারবার উপদেশই সম্বল হয়ে উঠছে। ঘরে থাকা বা নিরাপদ থাকার ব্যাপারে রাষ্ট্র ব্যাক্তিকেই প্রধান গন্য করছে এবং মহামারী কালে রাষ্ট্র এটাই করে।

স্বাভাবিক অবস্থায়, উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়, ট্যাক্স বৃদ্ধিকে জন-কল্যাণ বলে প্রচার করা হয়, রাষ্ট্রের সফলতার ব্যানার মোড়ে মোড়ে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক বিপরীতে সংকট কালে ব্যাক্তির পারফরম্যান্সকে মূখ্য বলে প্রচার করা হয়। অর্থাৎ স্ব-উদ্যোগে সংকট মোকাবিলা করুন, ঘরে থাকুন- সুস্থ থাকুন কিংবা ধান বন্যাকবলিত হলে শোনা যায়- বেশি করে আলু খান অথবা ধান, আলু উভয়ই নষ্ট হলে শুনবো- রাষ্ট্রের জন্য রোজা রাখুন ইত্যাদি।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমুহের ব্যার্থতা হিমালয় বা আল্পসের চেয়ে ভারী। ওপেন-ক্লোজ কিংবা রান-স্টপ ডিসিশনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেন আবাল বালক - মতিভ্রম মাথার মতোন হুটহাট ডিসিশন, হুটহাট হুংকার কিংবা হুট করেই সিদ্ধান্ত বাতিল। এটা বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা হয়ে সবখানে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বা অবহেলার অস্ত্রে খুন কমন ম্যাটারে পরিণত হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট, ম্যান্টালি সিক অর্থনৈতিক সিস্টেম বলবৎ রয়েছে। অ্যানি হাউ মুনাফা বৃদ্ধিই অর্থনীতির প্রধান কাজ। অর্থাৎ খাবারের জন্য নয়, কেকটা আরও বড় করার জন্যই কেক বানানো হয়েছে। অতীতের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ, অথচ দুর্ভিক্ষ, অনাহার কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা।

আজাইরা কাজ নিয়েও অর্থনীতিটা বেশ ব্যাস্ত। পয়সা কামানোই হক কথা; ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই- পর্নোগ্রাফি হলেও আপত্তি নেই। দ্রুত মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সাপ্লায়ের ইচ্ছা, লকডাউন, কোয়ারিন্টিন এর ইন্টেনশনও জন কল্যাণ নয়, বরং ক্ষমতা এবং অর্থ। অন্তত ট্রাম্প এবং তার সচিবের কথা থেকে তা স্পষ্ট।  সচিবতো বৃদ্ধ মানুষকে মূল্যই দিচ্ছেন না বরং ভাবছেন দু-চারজন বৃদ্ধ মরেও যদি অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকানো যায় সেটাই ভলো। অর্থাৎ লকডাউন তুলে নিতে চাই।

সামাজিক ক্ষেত্রে, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাও অধিক খোলাসা হয়েছে। বিশেষ করে টিস্যু পেপার হাওয়া হয়ে যাওয়া, স্যানিটাইজার উধাও- এসব জন স্বভাবের মানকে প্রতিফলিত করে। তার পরও পৃথিবীতে মানবিক আত্মার ডাক শোনা যাচ্ছে। বাজারী সভ্যতার যুগেও অস্থির হয়ে থাকা মানুষের চেতনার গভীরে অস্পষ্ট মানবিক আত্মার ডাক শোনা যাচ্ছে।  পাশে থাকা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। উদাসীন রাষ্ট্রের অপেক্ষা না করে ব্যাক্তিগণই প্রথম মানবিক আওয়াজ দিয়ে পাশে থাকার প্রত্যয় দেখিয়েছে। স্পষ্টত সে আওয়াজে দেশ-ধর্মের ভেদ নাই, নারী-পুরুষ নাই, শুধুই মানুষ আর মানবিকতা। হৃদয়ের গভীরতর খাঁদে লুপ্ত থাকা বৌদ্ধিক কন্ঠ শোনা যাচ্ছে - যে খাঁদে অলক্ষ্যে অশ্রুপাত হয় সিরীয় শিশুর জন্য, আফগান রাখালের জন্য, ফিলিস্তিনের বালকের জন্য,লক্ষ কোটি শরণার্থীর জন্য, অনাহারী আফ্রিকানদের জন্য...। খাঁদে নিমজ্জিত সে বোধের প্রকট হওয়া নতুন সূর্যোদয়কে নিশ্চিত করবে।

এ সংকটের সর্বোচ্চ শাস্তির মাত্রা এখনো অনির্ণেয়। এর পর আমরা- অধিক বর্বরতায় পর্যবসিত হবো নাকি মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলবো? চীন কেন্দ্রীক নয়া বলয় তৈরি হবে নাকি পুরনো মোড়লই যুদ্ধের হুংকার দেবে? সামাজিক অস্থিরতা আর আত্মহত্যা কি আরও বাড়বে? ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানগণ সিভারলি ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে উঠবে আর আন্ডার ওয়ার্ল্ড থেকে কোন মাফিয়া ডন পৃথিবীর ঘন্টা বাজাবে? নাকি বিজ্ঞানের আলোয় পথ চলবে পৃথিবী, মনুষ্যত্বের জয় গান গাইবে?

ড্রামাটিক কোন চেইঞ্জ হয়তো আসবেনা। তবে এ মহামারী পরবর্তী আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে আঞ্চলিক জোট সমূহ বৃদ্ধি পাবে। বৈশ্বিক জোট ও বৈশ্বিক সংস্থা সমূহ ঘন ঘন রিপোর্ট পেশ করবে, বৈঠক ডাকবে। মানবাধিকার নিয়ে আরও ব্যাপক আলোচনা, আন্দোলন শুরু হবে। করোনা কালের পূর্বে এবং চলমান সংকট সমূহ নির্মূল হবেনা, রিডিউস হবে এবং উদ্ভট গ্যাটিস বা জোড়াতলি শুরু হবে। একটা grammatical solution এ আসতেই হবে। চোখের সামনেই তো জোট সমূহ বেকার হয়ে আছে, পথের অসারতা ওপেন হয়ে আছে। আদি ইউরোপীয় ডাকাত সঙ্ঘের চেয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সক্ষমতা কমে গেছে, অন্তন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের ইউরোপীয় ইউনিয়নকে রূপকথা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটাই প্রকাশ পায়।

লিডারের কাজ সচিব করতে পারেনা বা সে দায় টুকুও থাকেনা। বৈশ্বিক মহা সচিবের বর্তমান কর্মতৎপরতা ও ভূমিকা দেখেই তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কাজেই সচিব বা আমলা নির্ভরতা নয় বরং জন প্রতিনিধি নির্ভরতায় জাতিসংঘ তার নির্বাক ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আঞ্চলিক জোট গুলোও যুক্তিযুক্ততা পাবে সে পথেই। আর এটা বাস্তবায়িত করতে গেলে বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামো অনিবার্য হয়ে উঠবে, ব্যকারণিক সমাধানটাই মূখ্য হয়ে উঠবে।

এখনতো মৃতের মুঠোয় বন্দী জীবন।

১৬.০৫.২০২০

No comments:

Post a Comment