Saturday, July 18, 2020

আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী : গারো, হাজং এবং কোচ || সোহানুর রহমান।







সোহানুর রহমান, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী।


 বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। আমাদের প্রিয় এই দেশের প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালি হলেও এখানে বসবাস করে নানা জাতি, নানা ভাষা ও নানান সংস্কৃতির মানুষ। বাংলাদেশে রয়েছে অনেকগুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। আদিবাসীদের অনেকেই উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামেও অভিহিত করে থাকেন। ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে আদিবাসীদের জন্য ‘এথনিক পপুলেশন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখা নিয়ে রয়েছে ভিন্নভিন্ন মত। উইকিপিডিয়াতে এই সংখ্যা ৪৫টি থাকলেও বিবিএস রিপোর্ট ১৯৮৪ ও ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ২৪ ও ২৯টি। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে এই সংখ্যা ২৭টি।

বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই সমতল অঞ্চলে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর ময়মনসিংহে রয়েছে ৯টি। শেরপুর জেলাতে ৯টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। শেরপুরে যেসব আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে- গারো, কোচ, হাজং, বানাই, রাজবংশী, বর্মন, ডালু, হদি এবং হরিজন। চলতি রচনাটি শেরপুরে বসবাসরত দুইটি প্রধান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিষয়াদি সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।


গারো

গারো দম্পতি 

 


মঙ্গোলিয় মানবধারার অন্তর্গত গারো জনগোষ্ঠীর বসবাস প্রধানত ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও সিলেট অঞ্চলে। গারো জনগোষ্ঠী মাতৃপ্রধান। মেয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারীনি। বিয়ের পর বর স্ত্রীর বাড়িতে বসবাস করে। সন্তানেরা মায়ের পদবী ধারণ করে। তবে মাতৃপ্রধান হলেও কি হবে পরিবার ও সমাজ পরিচালনায় গারো পুরুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

গারো সমাজে একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। গারোদের নিজস্ব ধর্ম রয়েছে। সেই ধর্মের নাম সাংসারেক। তবে আজকাল সিংহভাগ গারো খ্রিষ্টধর্ম পালন করে থাকে। তাদের প্রধান দেবতা ‘তাতারা রাবুগা’। অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে গয়রা, মিসি সালজং উল্লেখযোগ্য।

গারোরা বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। ‘ওয়ানগালা’ গারোদের প্রধান উৎসব। পুরোহিতকে তারা কামাল বা খামাল বলে।

গারোরা মান্দি বা আচিক ভাষায় কথা বললেও এদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই। গারোরা প্রধানত কৃষিজীবী। আগে এরা জুমচাষ করতো। এদের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, শাকসবজি ও পশুপাখির মাংস। নিজেদের তৈরি এক ধরনের পানীয় গারো সমাজে প্রচলিত। এটাকে চু বলে। এটি গারো সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান। পুরুষেরা গান্দো, পান্ত্রা, খুতুপ আর মেয়েরা দকমান্দা, দকশাড়ি ইত্যাদি পরিধান করে। গারোদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি রয়েছে।

হাজং

হাজং সম্প্রদায়

 


মঙ্গোলিয় জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত হাজংদের বসবাস প্রধানত শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতী,­­ নালিতাবাড়ি। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট এবং নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরি, সুসং দূর্গাপুর ও কলমাকান্দায়। এছাড়াও সিলেট, সুনামগঞ্জেও এদের বসবাস রয়েছে।

হাজংদের আদি নিবাস বার্মায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন আসামের হাজো নামক স্থানে বাস করতো বলে এদের নাম হাজং। হাজং শব্দের অর্থ মাটির পোকা। হাজংদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও কোন বর্ণমালা নেই। এরা অসমিয়া বর্ণমালা ব্যবহার করে। হাজংরা প্রধানত কৃষিজীবী। ভাত মাছ, শাক সবজি ও বিভিন্ন পশুপাখির মাংস এদের প্রিয় খাবার। নিজেদের তৈরি মদও এরা খেয়ে থাকে। মহিলারা নিজেদের তাঁতে তৈরি কাপড়, আর্গন নামের এক প্রকার চাদর এবং পুরুষেরা লুঙ্গি ,ধূতি ও জামা পরিধান করে।

পিতৃপ্রধান হাজং সমাজে ছেলেরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। হাজং সমাজ ৪ ভাগে বিভক্ত।
যথা- পাড়া, গাঁও, চাকলা এবং পুরাগাঁও বা পরগনা। গ্রামপ্রধানকে গাঁওবুড়া এবং চাকলা প্রধানকে গড়ে মোড়ল বলা হয়। এরা ১৭টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রকে এরা নিকনি বলে। হাজং সমাজে একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ।

কোচ

কোচ সম্প্রদায়

 


বাংলাদেশের প্রাচীন আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম হল কোচ জাতিগোষ্ঠী। কোচদের আদি নিবাস ভারতের কোচ বিহারে। বর্তমানে এদের বসবাস শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ির পাহাড়ি এলাকায়। গত শতাব্দীতে এদের সংখ্যা বেশি থাকলেও বর্তমানে এরা সংখ্যায় অনেক কম। কোচরা আটটি দলে বিভক্ত। যথা- হরিগাইয়া, সাতপাড়ি, ওয়ানাং, দশগাইয়া, চাপ্রা, তিনতিকিয়া, শংকর ও মরগান। প্রতিটি দলের আবার একাধিক গোত্র বা নিকিনি রয়েছে। কোচরা পিতৃপ্রধান হলেও সন্তানেরা মায়ের পদবি ধারণ করে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় পুত্র সন্তান। একই গোত্রে বিবাহ কোচ সমাজে নিষিদ্ধ। কোচ মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে চলে যায়।

কোচ পুরুষেরা সাধারণত ধূতি লুঙ্গি ও জামা পরিধান করে। মহিলারা পড়ে নিজেদের তাঁতে তৈরি লেফেন বা লৈফানেক। কোচদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও কোনো বর্ণমালা নেই। নিজের মধ্যে এরা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করলেও বাংলাতেই বেশি কথা বলে। কোচদের প্রধান খাবার ভাত। এছাড়াও শাকসবজি, ডাল, ডিম, মাছ ও মাংস খেয়ে থাকে। শূকর, খরগোশ, শজারুর মাংস এদের অতি প্রিয়। কুইচা, কচ্ছপসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণির মাংসও এরা খেয়ে থাকে। বিভিন্ন উৎসবে এরা পিঠা, ক্ষীর, পায়েস, মিষ্টি ও নিজেদের তৈরি মদ পান করে থাকে।

No comments:

Post a Comment