Monday, May 11, 2020

ধ্রুপদী চক্রসমূহ - ভূবন মুন্সী



ঋণগ্রস্ত যে ঘর- আতুর ঘরের শিশুটিও ঋণগ্রস্ত। শৈশব কাটে ঋণের বোঝার উপর হামাগুড়ি দিয়ে, যৌবনে ঠেলতে হয় ঋণের বোঝা আর বার্ধক্যে ঋণগ্রস্ত মনে বেজে ওঠে কাঁসার করুণ ঘন্টা; আর্তনাদে বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ঋণগ্রস্ততা, দারিদ্র্যতা- না দিলো শিক্ষার সুযোগ, না দিলো যুৎসই মুক্তির পথ। আর এভাবে, বৈকালিক ছায়ার মতোন দীর্ঘ কাল ধরে সময়ের প্রশস্ত পথে গাদাগাদি করে বহমান শীর্ণকায় মেজরিটি মানুষ; পুষ্টিহীন কোটরাগত চোখওয়ালা সে সমাজ আজও বর্তমান। এ চক্রভেদী অভিমন্যু শক্তি বা বেরিয়ে আসবার অর্জুনী কৌশল আজও জন্ম নেয়নি; অন্তত বৈশ্বিক চোখে তা দৃশ্যমান নয়।

রাজনীতি: যার 'যথার্থ' ভূমিকার সাথে জড়িয়ে থাকে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তব শর্ত, আর অধিকার প্রতিষ্ঠার শর্ত পূরণেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবীয় মর্যাদা। সংস্কৃতি মধ্যস্থিত সবচেয়ে ধারালো, সবচেয়ে তীক্ষ্ণ খঞ্জরের নাম- রাজনীতি; পরম্পরার পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রথা, রীতিনীতি বা সংস্কার সমূহ - যা ইতোমধ্যে ব্যাকডেটেড বা অপসংস্কৃতি হয়ে সেঁটে আছে সমাজস্থিত গায়ে- তা চারা বৃক্ষের মতোন সমূলে উৎপাটন বা আগাছার মতোন কর্তন করার আবশ্যকতায় রাজনীতির যথার্থ ভূমিকা অনিবার্য।

কিন্তু অসৎ রাজনীতিবিধ- রাজনীতি যাদের হস্তগত হওয়ার প্রেক্ষিতে অপরাজনীতি নাম ধরে, সামাজিক ন্যায় ও ন্যায্যতা বিরোধী শক্তি রূপে ভয়ংকর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা বা লুটেরা সংস্কৃতি জাহির রাখতে সক্ষম হয়েছে- সেই অসৎ হস্ততল হতে রাজনীতিটা মুক্তি পাচ্ছেনা বংশ পরম্পরায়। অনেকটা ঋণ চক্রের মতোন- রাজনীতিটা যেন 'সেই' জেষ্ঠ্য করতল হতে কনিষ্ঠ করতলে ট্রান্সফার হচ্ছে,  আর মোঙ্গলীয় কায়দায় শ্মশান করে যাচ্ছে মানচিত্র, মানুষ, মানুষের জীবন।

অসৎ করতল হতে রাজনীতিকে মুক্ত করার প্রয়াসে 'সচেতন সামাজিক শক্তির উত্থান' আবশ্যিক। এ উত্থান ও তৎসংশ্লিষ্টদের শাসন কায়েম বা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই রাজনীতি তার 'যথার্থ' ভূমিকা পালন করতে পারে।

রাজনীতি মারফত 'যথার্থ' ভূমিকা পালন করতে চাইলে, রাজনীতির যথার্থ রূপ বা যুগ সত্য বাস্তব চেহারা চেনা-জানা বা সচেতন দৃষ্টিতে রাখা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।

রাজনীতিকে ব্যাপক গণমানুষ এখনো মুখে মুখে রাজার নীতি হিসেবেই জানে বা আড্ডা, গল্পে, কথার উপমায় রাজার নীতি বলেই সাব্যস্ত করে।

রাজনীতি: যার মূল কাজ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা; অতীতের সমস্ত যুগে কিংবা রাজসিক বা সামন্ত যুগে রাজ্যের বিধি-বিধান বা ব্যবস্থাপনার সকল সিদ্ধান্ত রাজ্যের কেন্দ্র বা সিংহাসন হতে বেরিয়ে আসতো; যেখানে চূড়ান্ত বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন রাজা- এটা ছিলো মূলত কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা। আজ সিংহাসনে রাজা নেই, সংসদে আছেন জন প্রতিনিধি - যারা জনগণের ভোট মারফত নির্বাচিত, অর্থাৎ রাজা নয়, জনগণই ক্ষমতার উৎস।

কিন্তু এখনো কেন্দ্র কর্তৃকই ব্যবস্থাপনা বা বিধি-বিধান নির্ধারন করা হয় এবং জনমত এখনো গৌণ বা নিষ্প্রয়োজন হিসেবে চলমান। জনগণ দ্বারা রাজা সিংহাসন বিচ্যুত হলেও 'রাজারা' ক্ষমতার অলিন্দে বসে আছেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীভূত সেই শাসন বা সিংহাসনের সেই তরবারীর বিধান এখনো বর্তমান আছে,  আর এ প্রেক্ষাপটেই রাজনীতি রাজার নীতি হিসেবে পুরনো রূপেই ব্যাপক জনমনে জীবিত থাকতে পারছে।

পঠিতব্য : বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আপন স্বার্থ সিদ্ধির তাড়নায় রাজনীতিকে পরিচালনা করলেও, ভোট মারফত মত প্রদানের সক্ষমতা থাকায় শেষ পর্যন্ত জনগণই রাষ্ট্রের মালিক বলে গণ্য হয়। আর ভোটের অধিকার হারানোর মধ্য দিয়ে বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগ হয়ে উঠে সামন্ত যুগ, আর জনগণও মালিক থেকে হয়ে যান ভূমিদাস। অর্থাৎ ভোটের অধিকার হারানোর নিমিত্তে অতীতের সেই নেকড়েটা বর্তমানে এসে বর্তমান কে টেনে নিয়ে যায় অতীতের অন্ধকার গহ্বরে।


রাজনীতির 'যথার্থ' রূপ বা যুগ সত্য বাস্তব চেহারা চিনতে-জানতে গেলে প্রযুক্তিগত উত্তরণ সাযুজ্যতায় বর্তমান সময়কে চেনা-জানা খুব জরুরি। অতীতের সমস্ত সময় থেকে আজকের সময়টা সম্পূর্ণ নতুন, আর সম্পূর্ণ নতুন বলেই নতুন সত্য হাজির করে আমাদের দৃষ্টির সীমানায়। এ নতুন সত্য উপলব্ধিতেই অতীতের অচল কেন্দ্রীভূত কাঠমোকে বিদায় করে নতুন (বিকেন্দ্রীভূত কেন্দ্রীকরণ) কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হিসেবে গৃহীত হয়। নতুন কাঠমোর পথ ধরেই জনগণ কথিত মালিক বা ভূমিদাস থেকে হয়ে উঠবেন প্রকৃত মালিক, আর রাজনীতিও রাজার নীতি না থেকে হয়ে উঠবে জনগণ দ্বারা গৃহীত ও চালিত ব্যবস্থপনা বা বিধি-বিধান।

এ যাবৎকাল ধরে চলে আসা প্রায় ধ্রুপদী চক্র- ঋণ চক্র,  অপুষ্টি চক্র, অসৎ করতল চক্র বিদায় করার সময় সমাগত। নতুন সত্যে উদ্ভাসিত 'সচেতন তারুণ্যের ঐক্যতায়' কাঁচের মতোন খান খান হয়ে ভেঙে যাক প্রচলিত অচল, আর সেই দ্রোমিক কন্ঠে উচ্চারিত হোক- 'প্রাণ পণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল'।

৭.৫.২০২০

No comments:

Post a Comment