Tuesday, May 12, 2020

ফেসবুক, করোনা ভাইরাস এবং আমাদের পৃথিবী - ভূবন মুন্সী



৭০ হাজার বছর পূর্বে যে সেপিয়েন্সদের যাত্রা শুরু,  ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় টা কিন্তু কাটিয়েছে পরস্পর বিচ্ছিন্নতায়, অন্তত আজকের সময়ের তুলনায় একদম বিচ্ছিন্নতায় কাটিয়েছে বিগত পুরোটা সময়। শরীরগত অর্থে পৃথিবী এই সেদিন খোঁজে পেলো পূর্ণ রূপ ভৌগোলিক সীমারেখায়; কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লম্ফন এইতো সেদিনের ঘটনা; কম্পিউটার ব্যবহার, ইন্টারনেট সংযোগ, হাতে হাতে মোবাইল ফোন, ফেসবুক...।

যুদ্ধে জয়ী হতে ক্যাডার/লিডারদের হাতে পারমানবিক বোম- বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখলো মানুষ। হিরোশিমা, নাগাসাকি পুড়ে  ছাই হয়ে গেলো! আদতে জন-মানুষের কাছে এটা বিস্ময়কর হলেও ব্যবহারিক হয়ে উঠেনি।

মানুষ চাঁদে গেলো। কি বিস্ময়কর ব্যাপার! পত্রিকার পাতায়, পাঠ্য পুস্তকে নীল আর্মস্ট্রং এর ছবি পৌরাণিক হিরোর মতোন লাগতো। কিন্তু প্রত্যহিক জন যাপনে ভালো লাগার কল্পনা টুকুই যা, আর কিছু না।

অফিসে অফিসে কম্পিউটার। প্রযুক্তি এবার প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে বসে গেলো টেবিলে টেবিলে। প্রকৃতিগত শারীরিক শক্তিমত্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এক করে দিলো নারী ও পুরুষের সক্ষমতা। নারী ও  পুরুষের সমমর্যাদা ও  অধিকারকে বিজ্ঞানই প্রথম যৌক্তিক ভাবে স্বাগত জানালো।

মিডিয়া র‍্যাভুলেশন; ঘরে ঘরে স্যাটেলাইটিক চ্যানেল গুলো নূহের প্লাবনের চাইতে অধিক বেগবান প্লাবন নিয়ে আসলো বৈশ্বিক সংস্কৃতির ময়দানে। প্রাচীর ও কাঁটাতারকে তোয়াক্কা না করে অবাধে বিচরন করতে থাকলো ঘরে ঘরে। পৃথিবীর সংস্কৃতির পালে এই প্রথম বড়সড় এক ধাক্কা এসে আছড়ে পড়লো। সময় নিজেই যেন পৃথিবীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন এক কাঙ্খিত লক্ষ্যে। অবশ্য পুঁজিও তার আপন জাতীয় সীমানা ভেঙে পুরো পৃথিবীতেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার মাতাল ঘোড়ায় চড়ে।

বিশ্ব হয়ে উঠলো গাঁয়ের চেয়েও ছোট। পুরো পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় বন্দী; হাতে হাতে মোবাইল ফোন। এ এক আলাদীনের চেরাগ- দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো মানুষে মানুষে। পুরনো পৃথিবী এবার ভেঙে যেতে প্রস্তুত। বস্ত্র কল থামিয়ে দিয়েছিলো সামন্তবাদ, এনেছিলো ধনতন্ত্র। বাষ্পীয় ইঞ্জিন তো হাজার বছরের ভারতীয় সয়ম্ভর সমাজের ভিত্তি ভাঙতে প্রথম কুঠারাঘাত করেছিলো।

পৃথিবীটা আরও কিছুর প্রত্যাশায় ছিলো। সময়টা হয়তো ২০০৪; মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক এই প্রথম অলৌকিক ক্ষমতাধর দৈত্যের মতোন তছনছ করে দিলো সব। বরিশালের কেউ একজন হয়তো ব্রাজিলিয়ান তরুণীর সাথে প্রেম করে, বিয়ে-ঘর করে। না বুঝা ভাষা হয়তো ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে বুঝে নেয়। এই সীমানার বাইরের সম্পর্কটা পূর্বেও ছিলো, কিন্তু "কেউ একজনের" সম্ভব ছিলোনা। এবার যে কেউ যে কারো সাথে মেধা ও মননে নিজেদের এক করে নেওয়ার সুযোগ পেলো। আজ ৭.৮ বিলিয়ন মানুষের দুনিয়াতে ২.৬৫ বিলিয়নের বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে জড়িত, অন্তত প্রতিটি পরিবারের একজন জড়িত। প্রাযুক্তিক বিকাশে পৃথিবী আজ এক মহা পরিবার।

এবার মানুষ সবটা লাইভ জেনে যায় কিংবা মুহূর্তে।
গোপনটুকু চাইলেও আর গোপন থাকেনা শেষাবধি। বুআজিজির গায়ের আগুন আরব বসন্ত হয়ে মধ্য প্রাচ্যকে ধাক্কা মেরে যায়, যুদ্ধবাজ ক্যাডারদের একজন সাধারনও শালা বানচোৎ বলে কমেন্ট করে বসে, আমাজন-অস্ট্রেলিয়ার আগুন পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের হৃদয়কে তাপ দগ্ধ করে, কিংবা ফিলিস্তিনের যুদ্ধ হত্যার প্রতিবাদ বাংলাদেশে হয় অথবা ইন্ডিয়ার আইনের প্রতিবাদ লন্ডনে এবং এটা স্বতঃস্ফূর্ত সাধারন মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়।

এখনো কাঁটাতার শুধু জেগে থাকলো পুরনো অভ্যাসে, ক্যাডার/লিডারদের পুঁজির বিকাশে, অ্যাকাডেমিক বুদ্ধিজীবি/দার্শনিকদের অন্ধত্বে।

সময় হয়তো ইচ্ছাকৃত পৃথিবীকে টানছে পরিপূর্ণতার দিকে। করোনা এসে বৈশ্বিক সংকট সমূহ উদোম করে দিলো। আদতে দেশবাসীকে সেফ রাখার কোন পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা জাতীয় মুরুব্বিদের নেই। মসনদে বসে যতোটা ক্ষত্রিয় ভাব জাহির করে, এ্যাক্চুয়ালি ভিতরটা বৈশ্য। বাণিজ্য পাড়া ব্যাতিত, রাষ্ট্রিক পাড়ার মুরুব্বি হওয়ার যোগ্যতা নেই। বাণিজ্য পাড়ার জোট গুলোও এ করোনা সংকটে নিশ্চুপ। স্বঘোষিত মাতব্বর আমেরিকা নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত আছে। ইতালিও একা একা। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভূচিস  কোন সহায়তা না পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে "রূপকথা" বলে আখ্যায়িত করেছেন।

জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি কি করবে তারা, আজ অবধি পাঁজরের তলে কোন মেরুদণ্ড বসাতে পারেনি। মূখ্যত এ ধরনের বৈশ্বিক সংকট সমাধানে বৈশ্বিক পরিকল্পনা অনিবার্য। সংকট শুধু স্বাস্থ্যগত নয়, অর্থনৈতিক সংকটও এটা। ILO মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন- এটা শুধু বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট নয়, বৈশ্বিক শ্রমবাজার ও অর্থনীতির সংকট।

করোনা সংকট সমাধানে সাবান সচেতনতা ও সঙ্গরোধ কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও, অর্থনৈতিক সংকটটা সাবান/সোডা সচেতনতা দিয়ে সম্ভব নয়।

সংকট সমাধানে বৈশ্বিক পরিকল্পনা অনিবার্য, বিশেষত সংকট পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে। এটা রাষ্ট্র সমুহের পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতার উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে রাষ্ট্র সমুহের পারস্পরিক শর্তগত সম্পর্কের উপর- যা বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামোকে অনিবার্য করে তুলে।

পল ক্রুগম্যানরা এবার নিশ্চয় দৃষ্টি ফেরাবে। অন্তত মুরুব্বি রাষ্ট্র গুলো এটা আজ বুঝতে পারছে, একা একা ভালো থাকা যায় না। যুদ্ধবাজ চোখ গুলো এবার নিশ্চিত সমরাস্ত্র থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্থির করবে স্যানিটেশন ও ন্যায্যতায়। আপন সুস্থতার প্রশ্নে মানুষ প্রাণে প্রাণ মেলাবে পারস্পরিকতায়।

প্রাযুক্তিক বিকাশে এটা আজ স্পষ্ট সমগ্র মানুষের জন্য একটিই পৃথিবী, লাব্ববাইক কন্ঠের অধিকারী শুধুই মানুষ, নষ্টকে নষ্ট বলার বোধ কিংবা মানিনা বলতে পারা অথবা সুন্দরকে ধারন করা বা নতুনকে মেনে চলার সক্ষমতা শুধুই মানুষের।

ভালোটা তরঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে যায় সমগ্র ভুবন, তেমনি মন্দটা বিষ হয়ে বিষিয়ে দেয় সবার যাপন। বেঁচে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার একটিই কিশতি আজ, ভালো বা মন্দ সবটা সবার সাথে একাকার।

করোনা সংকট উৎরে নতুন এক পৃথিবীর দিকে মানুষের যাত্রা শুভ হোক।


৩১.০৩.২০২০

No comments:

Post a Comment