Monday, May 18, 2020

কার ঘরে কে আগুন ধরায়? - মোঃ শামীম রেজা




রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর, খাতা-বইপত্র, বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো হয়নি বরং বাংলাদেশের আত্মা পোড়ানো হয়েছে। গত চল্লশি বছর ধরে যে ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছিল তার পূর্ব ধারার পরম্পরা হিসেবে, যা বাঙলার একেবারে ভিতরের শক্তি। সমাজের কোষকে রক্ষা করে যে ধারা-সংস্কৃতি, শহুরে ভাষায় যাকে বলা হয় ঐতিহ্য তাকে যদি পোড়ানো হয় তো সে সমাজের থাকে কি?

কিন্তু এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কিভাবে? কোন দর্শন, কোন বোধ, কোন রাজনৈতিক চেতনা সমাজের ভিতরেই এমন ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে ফেললো?

রণেশ ঠাকুর বলতেই পারছেন না তার এমন কোন শত্রু আছে যে কিনা তার গানের ঘরটাই আগুন দিতে পারে। এটা তো আরো ভয়ংকর যে শত্রু চিহ্নিত নয় অথচ শত্রুতার স্বীকার হতে হলো তাকে। প্রকৃত অর্থে এই আগুন বাংলাদেশের সেই সাধনার ঘরে লাগানো হলো যেখানে জন্মহয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার, যেখানে লালন পালন হয় সেই পরম সত্যের যে বলে " তন্ত্র মন্ত্র করে দেখি তাহার ভিতর তুমি নাই শাস্ত্র গ্রন্থ যত পড়ি আরো দুরে সরে যাই, কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে"।

শাস্ত্র-গ্রন্থের যে মৌল আচার তাকে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে, এবং ভক্তিবাদের যে কথা বলা হচ্ছে সেটা বাঙলার একেবারে নিজস্ব শক্তি। শক্তিই বলতে হয়। আজকের পৃথিবীতে মানুষ যখন শুধু বস্তুবাদী জ্ঞানের সন্ধান করে নিজেকে জড় বস্তুর অনুগামী করে ফেলছে, পারস্পারিকতাহীন, অবিশ্বাসের কানাগলির ভিতর প্রতিনিয়ত ঘোর-পাক খেতে খেতে জীবনকে শুধুই একটা ভারবাহী যন্ত্র বানিয়ে ফেলছে সেখানে এই ভক্তি আর প্রেম ছাড়া মুক্তি কোথায় এই যান্ত্রিকতা থেকে? আগামীর পৃথিবীতে রাষ্ট্র বলতে তো একটা বিশ্বাসের সীমানা হয়ে থাকা ছাড়া তার অস্তিত্ব কোথায় সীমানাগত অর্থে?

কিন্তু ব্যবস্থাপনা তো থাকবে।


সবচাইতে বড় সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বায়নের এই যুগে লোকাল আইডেন্টিটি নিয়ে
যে জ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে বিশ্বায়নের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রযুক্তির হাত ধরে কেন্দ্রমুখি অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেই জ্ঞান বা দর্শন  কি পৃথিবীর বিকেন্দ্রে থাকা মানুষগুলোর জীবন ব্যবস্থায় তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছে? বরং এই দর্শন কাঠামো তাদের প্রাণ থেকে শুষে নিয়েছে তাদের প্রাণ শক্তি্ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত করেছে অসংখ্য প্রাণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিনিময়ে অংশীদার করেছে বিভিন্ন রোগ, মহামারী, পরিবেশ দূষণের, মত মহাপাপের। আগামীর পৃথিবী তে লোকাল সংস্কৃতি, আচার,বিশ্বাস এই কেন্দ্রমুখী মৌল ব্যবস্থার প্রতিরোধক হতে পারে। কারণ তা প্রকৃতিসম্মত হয়েই ভারসাম্য নিয়ে গড়ে ওঠা।


 বাংলাদেশের প্রাণশক্তি কোথায়? কোথায় তার শিকড়? কেন অধিকাংশ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও বহু চেষ্টার পরও এখানে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদীতা ভিটে পায় না?  প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেদের প্রশ্নেই খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঘরে আগুন জ্বললো বলে দেখা গেল তা নেভানোর চেষ্টাও করা হলো (যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে)। কিন্ত যে হৃদয় এই খাতা পত্রের চর্চা করতো সে কি আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারবে নাকি চাইবে? পুড়ে যাওয়ার ভয় কিংবা আতঙ্ক তাকে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি রেখে দুঃস্বপ্নের বেদনার মত ছুটিয়ে বেড়াবে না তো? যে বাদ্যযন্ত্র গুলো পরম মমতায় সাড়া দিত যে হাতের স্পর্শে, সে হাত আর বেজে উঠতে চাইবে কি?
এসবের কোন উত্তর আমাদের জানা নাই।  একজন রণেশ ঠাকুর কে বাংলাদেশের অসম্প্রদায়িক চেতনার দুর্গ হিসেবে দেখলে সে দূর্গে আঘাত হেনেছে যারা তারা এর বিপরীতে কি গড়ে তুলতে চাইছে? কোন সমাজ গড়ে তুলতে চাই তারা?

যারা আগুন ধরিয়েছে তারা যে অবুঝের মতো নিজেদের শরীরেই আত্মায় আগুন ধরালো এটাও তাদের জানতে দিতে হবে সে জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা রাষ্ট্র এবং সমাজ উভয়ের মিলেমিশে করতে হবে।
এ আগুন কোথায় লেগেছে? শাহ আব্দুল করিমের শিষ্যের গানের ঘর, বইপত্র,বাদ্যযন্ত্র আগুনে পুড়ে গেল নাকি বাংলাদেশের যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানবিক বোধের ঘর পুড়ল? ভেবে দেখার সময় আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামীর কোন বাংলাদেশ দেখতে চাইছি আমরা।

১৯.০৫.২০২০

No comments:

Post a Comment