Thursday, May 28, 2020

জীবন বেচে দিয়েছি সিটিসেল রেটে - ভূবন মুন্সী


'মানুষ, মানে যারা মারণমন্ত্র, শেল তৈরি করতে পারে? তার চেয়ে যারা তাল পাতার ব্যাগ তৈরি করতে পারে তারা বেশি মানুষ। যারা একশোবার করে ইউরোপ, আমেরিকায়, এশিয়ায় কনফারেন্স পাতায় আর ভাঙ্গে, পরস্পরকে বজ্জাৎ বলে গালাগাল দেয়- একেবারে উৎখাত করে ফেলবার ফিকিরে থাকে, তারাই তো মানুষ এখনকার পৃথিবীতে; আর তাদের তাবেদাররা - ব্যাঙ্কে অফিসে - ডিপার্টমেন্টাল চেয়ারে বসে পৃথিবীর সর্বত্র।' তারাই আজ সর্দার, শ্রেষ্ঠ - 'যারা প্রাসাদের সচিত্র গলিতে জমে ষড়যন্ত্রে, মন্দিরের উদার অলিন্দে মাতে ষড়যন্ত্রে।'

মেজরিটি মানুষও তাদের চিন্তায়, চেতনায় চালিত। সাধারনত 'আহার, পান, অর্থোপার্জন ও বংশ বৃদ্ধি যেন গণিতের নিয়মে অতি সুশৃঙ্খল ভাবে পরপর সম্পাদিত হয়ে চলেছে। বেশ সুখী তারা। তাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয়না।' সব কিছুতেই যেন বোহেমিয়ানায় ভেসে যাওয়া।

'মানুষ যা প্রকৃত নয়, নিজেকে যখন তাই ভাবে- তখনিতো এগিয়ে আসে জ্বরা, সমস্ত নকল, বর্তমান হয়ে উঠে করুণ প্রাক্তন।' এক গলা নোংরা জলে ডোবে যায় মানচিত্র। শকুনি ডানা মেলে আকাশে। আজ 'লক্ষ কোটি শকুনি পাখা বিস্তার করেছে আকাশে। যে আলোয় আলোকিত থাকতো পৃথিবী, সে আলোটা আড়ালে পড়েছে। পৃথিবীময় শকুনি পাখার অন্ধকার ছায়া।'

'পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতদেহের দুর্গন্ধের মতো।' 'কোথায় সমাজ, অর্থনীতি? - স্বর্গগামী সিঁড়ি?' ' যতই শান্তিতে স্থির হয়ে যেতে চাই, কোথাও আঘাত ছাড়া - তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রগামী সূর্যালোক নেই।'

জীবনকে যেন বেচে দিয়েছে সিটিসেল রেটে; পোদ্দারের  হাতে। স্বার্থের মদ গিলে মগ্ন সবাই। জুয়া খেলছে জীবন বাজি রেখে। 'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।'

তবু মুখোমুখি দাঁড়াবার সময় কোথায়? মুখোমুখি দাঁড়াবার মানুষ কোথায়? 'আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ করে দিলাম, সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুনতো আমরা আমাদের কাছে বলতে পেরেছি, ভালো আছি, খুব ভালো আছি।'

কেউ বলছিনা এসব। ভাবছিনা। কেউ বলছেনা- 'আমি ঘোষণা দিচ্ছি ডিটেনশন সেল থেকে।' আমি তোমাদের অগ্রাহ্য করি।

কেউ বলছেনা - 'তোমাকে জিততে হবে মনে রেখো, ফেরার সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে।'

আসলেই ফেরার সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তবু কেউ কিছু বলছেনা। কেন বলছেনা? ভেবেছিলাম  মানুষ ক্রমশ বড় হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য হবে। দেখি সত্য হয়ে গেছে রোবট - সঙ্গী হয়ে গেছে মানুষের।

দেখি এক পাল মাথা মোটা ষাঁড়। এক পাল ভেড়া। এক পাল গরু - পৃথিবীতে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি - প্রচন্ড রকম ভীড়। দেখি সবাই - নিউট্রন বোম বুঝে, মানুষ বুঝেনা।

ফিরে যাই নিজের কাছে। আর্চনায় জপি-
'Show me your ways
My Lord;
teach me your paths.
Lead me in your truth
and teach me.'

আলোর ঝলক ছুটে আসে আমার দিকে-  ইতিহাসের পথ বেয়ে; যে ইতিহাসকে জেনেছি - 'ইতিহাস বেলেল্লা মিছিল ছাড়া কিছু নয়, চুন- কালি- সঙের মিছিল ছাড়া কিছু নয়' - তা এবার পথ হয়ে উঠে আসে। 'মানুষের ঘামে নিষিক্ত শ্রম আমাকে আলোকিত করে। শ্রমের ঘামে এক-একটি ফোঁটা যেন এক-একটি হীরকখণ্ড। এর এই শ্রম যেন এক বিস্ফোরক এবং এই বিস্ফোরণই আমাকে অজ্ঞতা থেকে, অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে, আলোর ঝলকানিতে আমাকে জাগিয়ে দেয়, আমি চেতনা ফিরে পাই, আমি জেগে উঠি। সেই মিথ্যে, অজ্ঞতা আর অন্ধকারের দিন চলে গেছে। বিজ্ঞানের আলোক সম্পাত চারদিক উদ্ভাসিত করেছে। এবার তবে চলতে হবে বিজ্ঞানের আলোয়, যেতে হবে সামনে, আরো সামনে এবং অনেক দূর- দূরান্তরে।'

'সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এ পথেই পৃথিবীর ক্রম মুক্তি হবে।'

২৮.০৫.২০২০

কৃতজ্ঞতাঃ
১. জীবনানন্দের জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস - এক জন কমলালেবু - শাহাদুজ্জামান।
২. মরচে পড়া পেরেকের গান - হ্যেল্ডার্লিন, অনুবাদ- বুদ্ধদেব বসু।
৩. এক অনন্ত জীবনের জীবনী- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪. দরজার বাইরে- সমরেন্দ্র।
৫. সংশপ্তক - শহীদুল্লা কায়সার।
৬. জন্ম মৃত্যু-জীবনযাপন - আবুল হাসান।
৭. আমি তোমাদের অগ্রাহ্য করি - মাহমুদ দারবিশ, ইংরেজি অনুবাদ- সাদি সিমাবি & এলেন।
৮. মিছিলে নতুন মুখ - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
৯. চণ্ডীদাস।
১০. অশ্লীল সভ্যতা - হেলাল হাফিজ।
১১. Bible
১২. Lightining - RimBaud, অনুবাদ - সফিউদ্দিন আহমদ।

Tuesday, May 26, 2020

মানুষের মানচিত্র - এম. ইকবাল


মানুষ শব্দটার সাথে মান-সম্মানবোধের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে মানুষটার নিজের মান-সম্মানবোধ আছে সে তুচ্ছ কারনে কাউকে অপমান করতে পারে না। বিশেষ করে মানুষটি যখন বৃদ্ধ, বাবার বয়সী, তার অসচেতনতাকে শাস্তিযোগ্য ভাবাটাই একটা অপরাধ।

Google করে জানতে পারলাম-

১. মানুষ শব্দটি এসেছে হিন্দু পুরানে বর্নিত মানু শব্দ থেকে। মানু শব্দের অর্থ প্রত্নতাত্ত্বিক পুরুষ বা প্রথম পুরুষ। মানু একটি বিশেষন। পুরানে অনেক মহাপুরুষকে মানু বলা হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ মানব বলতে বুঝায় মানুর সন্তান। মানু থেকে মানুষ শব্দের উৎপত্তি।

আসলে 'মানুষ' শব্দের উৎপত্তি হয় 'মান' ও 'হুশ' শব্দদ্বয় যুক্ত হয়ে। (ভাবার্থ: 'মান' তথা 'আত্মসম্মানবোধ' এবং 'হুশ' তথা 'বিবেক' যার আছে সেই মানুষ।

২. হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে− ব্রহ্মার মন থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন মনু । আর মনু থেকে মানুষ জাতির উৎপত্তি হয়েছিল।

৩. মানুষ শব্দটির মূল আরবী ধাতু হচ্ছে 'উনসুনম্ব, আর উনসুন মানে হচ্ছে স্নেহ ভালোবাসা। যার মধ্যে এই স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে দেয়া হয়েছে আরবীতে তাকে বলা হয় 'মানুষম্ব।

প্রচলিত অর্থে যার মধ্যে যথার্থ মান-সম্মানবোধ, বিবেকবোধ (বিচার-বিশ্লেষন-বিবেচনা করার ক্ষমতা), স্নেহ-ভালোবাসা আছে সেই মানুষ।

যদিও এই আধুনিক সময়ে ‘মানুষ’ বলতে শুধু ‘মনুষ্যত্ব’ সম্পন্ন মানুষকেই বোঝায়। আর মনুষ্যত্ব বলতে সমাজগত পরম্পরা আর পারস্পারিকতায় অর্জিত সংস্কৃতিকে বোঝায়। অবিরত সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই যা এগিয়ে নিতে হয়।

জংগলে বেড়ে উঠা একটা মানবশিশুর আচরন জংলীর মতই হয়। এজন্য একটা মানব শিশু ও জানোয়ারের বাচ্চার মধ্যে খুব বেশি  পার্থক্য নেই। পার্থক্য তৈরী হয় যখন মানবশিশু সমাজ থেকে শিক্ষা গ্রহন করে মানবীয় গুনাবলী অর্থাৎ মনুষ্যত্ব অর্জন করে।

প্রশ্ন হলো,

আজকের সমাজ কি মানবীয় গুনসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে সক্ষম? 

আজকের শিক্ষাব্যবস্থা কি আমাদের যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক?  

আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি চায় আমরা যথার্থ মানুষ হয়ে উঠি? 

তাহলে আমরা কি করে আশা করি যে ডিগ্রি অর্জন করলেই কারো মধ্যে বিবেকবোধ থাকবে? 

এরপরও আমরা যতটুকু মানুষ হতে পেরেছি তা আমাদের বাবা-মা চেয়েছেন বলে।

জন্মের পর থেকে আমরা যা শিখেছি মা-বাবার কাছ থেকে, ততটুকুই মানুষ হতে পেরেছি। মানুষ হিসেবে আরো উন্নত হয়ে গড়ে উঠবার বাকি দায়িত্বটুকু ছিল রাষ্টের শিক্ষাব্যবস্থার হাতে। রাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ। অথচ আমরা সেখানে সরব না হয়ে তথাকথিত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত একজন ব্যক্তি যখন কোথাও বিবেকবর্জিত, দায়িত্বহীন কর্তৃত্ববাদী আচরণ প্রকাশ করছে তখন সবাই তার বিরুদ্ধে বিষোধগার প্রকাশ করছি।

কি করে আমরা একটা অন্তঃসারশূন্য শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা গড়ে উঠা প্রজন্মের কাছ থেকে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ আশা করছি? 

নিঃসন্দেহে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার দায়িত্বজ্ঞানহীন ( মাস্ক না পরার কারনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে ছবি তুলে) খবরদারি করেছে। আমাদের দেশে ব্যপক মানুষের মধ্যে যেমন সচেতনতার অভাব রয়েছে তেমনি বিশাল জনগোষ্ঠীর ঘরে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। একদিন কাজে না বেরুলে ঘরের সদস্যদের মুখে খাবার জুটবে না। এ ধরনের মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শাস্তির বদলে মুখের মাস্ক সরবরাহ করা উচিৎ ছিল।

খেটে খাওয়া অসচেতন মানুষগুলোর প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন না করেই কি করে তাদের কাছ থেকে সচেতনতা আশা করে? দায়িত্ব ও কর্তব্যহীন কোনো দাবিই কি বৈধ? 

কথা হলো, আম গাছ থেকে কাঁঠাল আশা করা কি যৌক্তিক?
অথবা বিড়ালের ঘরে কি বাঘের জন্ম হয়?

মার্চ, ২৮, ২০২০

Monday, May 25, 2020

প্রাতিষ্ঠানিক সংকটে রাজনীতি - ভূবন মুন্সী


প্রাতিষ্ঠানিকতার অনুপস্থিতিতে ব্যাক্তিই প্রতিষ্ঠানের সর্দার হয়ে উঠে, তার অঙ্গুলি হেলনে বা ইশারা ইঙ্গিতে চলতে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোড়া। পরিবার সম্পৃক্তরাই সে ঘোড়াতে চড়ে দাপটে নষ্ট করে সাজানো বাগান। প্রকৃতিগত সত্যে সর্দার এর অনুপস্থিতিতে যেন তেন লোক পিঠ চাপে সাওয়ারী হয়ে এবং সর্দারিজমে সে সুযোগটুকু থাকে। কাজেই প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করাই সৎ, যোগ্য ও ব্যাকারণিক কাজ। এর বাহিরে গিয়ে চেঙ্গিস খান, হিটলার কিংবা আকবর হয়ে উঠলেও বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ঠেকানোর সক্ষমতা আজ কারো নেই। সাময়িক বাহবা জুটলেও অশান্তির কারন হয়ে সে বা তারা দ্রষ্টব্য হবে ইতিহাসে।

আর "রাষ্ট্র ও রাজনীতি" প্রাসঙ্গিকতায় রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাটা খুব জরুরী। আইনের শাসনের নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সবার অন্তর্ভুক্তি কিংবা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থে ব্যবহার ঠেকাতে যথাযথ পদক্ষেপ রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরন। রাষ্ট্র হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, আর প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি মূখ্য থাকলে ব্যক্তি বাঘ হয়ে উঠা তাজ্জবের কিছু নয়। তবু আমরা মাথাওয়ালারা দ্রষ্টব্য পথ এড়িয়ে নানান ফতোয়া নিয়ে ইলেক্ট্রিক ওয়ালে হাজির হই। আমরা জনগন সাত পাঁচ বয়ান শুনে ঘুম থেকে জেগে দেখি সেই পুরনো দিন।

রাজনীতির বিপরীতে যেমন রাজনীতিই থাকে, তেমনি রাজনৈতিক সংকট সমাধান রাজনৈতিক পথে রাজনীতিকদেরই করতে হয়। মুচি সেলাই জানলেও অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারেরই প্রয়োজন পড়ে। তবু দেখি, বই কানা দিচ্ছে পথ স্বার্থ কানার ইচ্ছে মতো।

বিংশের একুশ থেকে একাত্তর- আজকে দ্রোহের দিনগুলি কেমন ম্লান! পরম্পরা হারালে ওল্ড ইজ গোল্ড না থেকে পিতল হয়ে ওঠে, এটাই সত্য। একবিংশের একুশ আগত প্রায়, তবু হেড আসার কথা থাকলেও টেল এসে দাঁড়িয়ে আছে খাম্বা হয়ে।

তবে, বৌদ্ধক করাতে বাধার খাম খুঁটি কেটে আজ প্রশস্থ করি প্রাত্যহিক পথ। প্রাতিষ্ঠানিকতার পথ ধরে "সূ্র্য উদয় অস্তাচলের"  দ্বীপ হতে শুরু হোক আধুনিক রাজনীতি।

১৩.০৭.১৯

Sunday, May 24, 2020

করোনা ভাইরাস ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে? চীন নয়, দোষ পুঁজিবাদের - লি ঝাং

অনুবাদঃ ভূবন মুন্সী।



চীনে কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই তার উৎস সম্পর্কে ধারণা করার জন্য অনেক গবেষণা হয়েছে। এই ইস্যুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে "নতুন স্নায়ু যুদ্ধ" তে অত্যন্ত রাজনৈতিকীকরণ করা হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, স্টেট সেক্রেটারি মাইক পাম্পো এবং রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন সবার বক্তব্য করোনা ভাইরাস উহানের একটি ল্যাব থেকে এসেছে। জবাবে, চীনা সরকারী কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, ভাইরাসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন ল্যাবে উদ্ভূত হতে পারে।

যদিও এই দোষারূপের খেলাটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে শিরোনাম তৈরি করছে, ধোঁয়া এবং আয়নার আড়ালে মহামারীটির প্রকৃত কারণটি লুকিয়ে আছে - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং বাকি বিশ্বের ভাগ্যের একটি সাধারণ সমস্যা - পুঁজিবাদ।


Covid-19 এর উৎস সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও, আমরা কিছু কিছু জানি। জানুয়ারির প্রথম দিকে নতুন করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবং একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ঐক্য  হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যে এটি মূলত বাঁদুড়ে  বিকশিত হয়েছিল। সম্ভবত একটি মধ্যস্থতাকারী প্রজাতির মাধ্যমে মানুষের কাছে চলে যায়।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দাবি, প্যাঙ্গোলিন, উদ্ভিদ চক্র বা ফেরেট সম্ভবত বৃক্ষ ও মানুষের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করেছে। ভাইরাস ইচ্ছাকৃতভাবে কোন পরীক্ষাগারে নির্মিত এমন কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন গোয়েন্দা সম্প্রদায়টি বারবার বলেছে যে তারা বিশ্বাস করে যে নতুন ভাইরাসটির উৎস প্রকৃতি।

কিন্তু কিভাবে এই ন্যাচারাল স্পিলওভার উহানে একটি প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করেছে? "দোষী চীন" অলঙ্কারটি এখন Wuhan Institute of Virology এর একটি সম্ভাব্য দুর্ঘটনা নির্দেশ করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা- বাঁদুড় থেকে করোনা ভাইরাস এবং নতুন মহামারী তথ্য না আসা পর্যন্ত একটি ল্যাব দুর্ঘটনা জড়িত তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করা অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু যদি আমরা এটাকে 'ল্যাব লিক' অনুমান করি, তবুও  চীনকে দোষারোপ করাই কী  সমস্যাটি সম্পর্কে চিন্তা করার  সঠিক পথ?

বিপজ্জনক রোগের সাথে জড়িত ল্যাবরেটরি দুর্ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সমগ্র বিশ্ব অনেকবার ঘটেছে। ২০১৪ সালে, খাদ্য ও মাদকদ্রব্য প্রশাসন একটি অনিরাপদ স্টোরেজ রুমে দুর্ঘটনাক্রমে স্মলপ্ক্স এর ছয়টি বোতল পায়।

একই বছর, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলি দুর্ঘটনাক্রমে তিনটি অনিরাপদ ল্যাবে কার্যকরী অ্যানথ্রাক্স স্পোর পাঠায়, সম্ভবত গবেষকরা মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া বহন করছিলেন।। তারপর ২0১৫ সালে, পেন্টাগন দুর্ঘটনাক্রমে নয়টি রাজ্যে এবং এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত জীবন্ত অ্যানথ্র্যাক্স প্রেরণ করে।

সৌভাগ্যক্রমে, সেই দুর্ঘটনায় কোনও মৃত্যু ঘটেনি, কিন্তু এমন কিছু হয়েছে যা মারাত্মক। আমেরিকান জৈবিক সুরক্ষা সংস্থার ক্যারন বেয়ার এর একটি গবেষণার মতে, ১৯৭৯ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী "ল্যাবরেটরি অর্জিত সংক্রমণ" এর কমপক্ষে ১১৪১ টি উদাহরণ ছিল, যার মধ্যে কয়েকটির ফলাফল মৃত্যু।

স্মলপক্সের সাথে জড়িত কয়েকটি দুর্ঘটনায় ১৯৭০ সালে তিন জনের মৃত্যু হয়। চীনে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস লিক হয়ে ১৯৭০ এর দশকে একটি প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করে যা দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। ভেনিজুয়েলা এবং কলম্বিয়াতে এনসেফালাইটিসের একটি মহামারীতে ১৯৯৫ সালে কমপক্ষে ৩১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল সম্ভবত কোনও পরীক্ষাগারের ঘটনার ফলে।

২০০৩ এবং ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান এবং মূল ভূখণ্ড চীনের ল্যাব কর্মীরা দুর্ঘটনাক্রমে এসএআরএস-তে সংক্রামিত হয়েছিল এবং এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং মহামারীটি সংক্রামিত হওয়ার পরে একজনের মৃত্যু ঘটেছিল।

ল্যাবরেটরি দুর্ঘটনা একটি দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু অত্যন্ত সংক্রামক এবং মারাত্মক রোগের গবেষণার অনিবার্য পরিণতি। কোন দেশ তাদের প্রতিরক্ষা করে না।

মূল চাবি হলো, বুঝতে হবে কেন এমন রোগগুলি প্রথম স্থানে পরিণত হয় এবং কীভাবে তাদের প্রতিরোধ করা যায়। এখানে বৈজ্ঞানিক ঐক্যমত্য পরিষ্কারভাবে পুরো পৃথিবীকে প্রভাবিত করে এমন কাঠামোগত সমস্যাগুলির দিকে নির্দেশ করে।

প্রথমত, দ্রুত নগরায়ণ এবং বর্ধিত গতিশীলতা স্থানীয় প্রাদুর্ভাবের মহামারী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।  উহান একটি বড় পরিবহন কেন্দ্র এবং চীন এখন বহু বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে।  এই উভয় কারণই করোনাভাইরাস দ্রুত প্রসারে অবদান রেখেছিল।

বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান এবং বন ও পাহাড়ের গভীরে নতুন অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ফলে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে নতুন নতুন রোগের ঝুঁকির পরিমাণ বেড়েছে।  গত কয়েক দশক ধরে বর্ধিত গ্রাহকত্বের বিকাশের ফলে বন্য প্রাণী ব্যবসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

পান্ডোলিনের মতো বন্য প্রাণী, যা খাদ্য এবং ঐতিহ্যবাহী ঔষধের জন্য ব্যবহৃত হয়, মহামারীটির আগে উদ্বেগজনক হারে চীন পাচার করা হয়েছিল।  একই সাথে পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রয়াসে, চীন সরকার কিছু বুনো প্রাণীর বাজারমুখী প্রজনন এবং ই-বাণিজ্য প্রচার করেছিল। উহানের মতো স্যাঁতস্যাঁতে বাজারে বুনো প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে এই অনুশীলনগুলি ঘনিষ্ঠ এবং সম্ভাব্য সংক্রমণ-সংক্রমণকারী মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেখানে করোনা ভাইরাস উদ্ভব হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

শিল্প-মাপের হাঁস-মুরগি ও প্রাণিসম্পদ নতুন প্রাণীগত রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, যা মহামারী হতে পারে।  বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী রব ওয়ালেসের যুক্তি অনুসারে, পুঁজিবাদী কৃষিকাজ "রোগজীবাণুগুলির সবচেয়ে জঘন্য এবং সংক্রামক ফেনোটাইপগুলি বিকশিত করতে পারে তার সঠিক উপায় সরবরাহ করে"।

বন ও অন্যান্য আবাসস্থল ধ্বংস, ভোগবাদ, বন্য প্রাণীর বাণিজ্য এবং শিল্প-স্তরের প্রাণীজ প্রজনন চীনের পক্ষে অনন্য নয়। এগুলি বিশ্বব্যাপী ঘটনা।

এই মহামারীটি যদি চীনে উৎপন্ন হয়, পরেরটি ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথা হতে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং এটাই সত্যি।

এই ট্র্যাজেডির জন্য বাণিজ্যিক দোষরোপ বিশ্ব নেতাদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সমীচীন হতে পারে এবং ল্যাব ফাঁসের ধারণাটি কার্যকর হতে পারে, তবে এর কিছুই বিশ্বকে এর সাথে আরও ভাল মোকাবেলায় সহায়তা করছে না।

প্রকৃত সমস্যা যা নতুন রোগের জন্ম দেয় এবং বৈশ্বিক মহামারীর কারণ, কেবলমাত্র ল্যাব দুর্ঘটনা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং অবিচ্ছিন্ন।

২২মে ২০২০,  আল জাজিরা।
লেখক
লি ঝাং।

লি ঝাং, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরভিনের আন্তর্জাতিক স্টাডিজের ভিজিটিং সহকারী অধ্যাপক।

Saturday, May 23, 2020

গোটা ব্যবস্থাটাই যখন জবাবদিহিহীন - আলী রীয়াজ



প্রায়শই একটা কথা শুনতে পাই, বিভিন্ন লেখায় পড়ি, কেউ কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবেও পোস্ট করেন - ‘দেশকে বদলাতে হলে আগে মানুষকে বদলাতে হবে’|

কেউ কেউ উদাত্ত আহবান জানান, ‘আসুন, নিজেকে বদলাই’| কিন্তু কেউ কি এমন দুইটা উদাহরণ দিতে পারবেন যে, রাষ্ট্র বদলানোর আগে, রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো বদলানোর আগে, রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ পরিবর্তনের আগে সব বা অধিকাংশ মানুষ ‘বদলে’ গেছে এবং তারপরে রাষ্ট্র, সরকার, দেশ, সমাজ বদলেছে? ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই পর্যন্ত কবে কোথায় এই ঘটনা ঘটেছে?  এই প্রশ্নটা কৌতুহল হিসেবে বিবেচনা করুন|

ব্যক্তিকে নিজেকে বদল করতে বলা আসলে বিরাজনীতিকীকরণের উদাহরণ| ব্যক্তির আচরণ বদলে ফেলে আপনি বড়জোর নিজের উঠোন পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবেন; রাষ্ট্র্রের অনাচার বন্ধ করতে পারবেন না|

বিরাজমান ব্যবস্থা টিকে থাকার দায় ব্যক্তির ঐটুকুই যে তিনি তা গড়ে ওঠার সময় প্রতিবাদ- প্রতিরোধ করেনি, কিন্তু চলমান অবস্থার দায় - সব অন্যায়ের দায় তাঁর কাঁধে তুলে দিয়ে তাকেই অপরাধী বানানো, তাকে হতাশ করা, তাঁর চারপাশের মানুষের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরী করার উদ্দেশ্য একটাই - সম্মিলিত প্রতিরোধের ধারণাকে অবসিত করা|

‘নিজে ঠিক থাকলে সব ঠিক’, ‘দোষ হইলো মানুষের’ , ‘আমরা যেমন তেমনি অবস্থা’ এই জাতীয় কথা বিশ্বাস করা ও বলার জন্যে উৎসাহ জোগানোর উদ্দেশ্য - আপনি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, অন্যায় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না| ওই প্রশ্ন তোলাটাই রাজনীতি; পরিবর্তনের প্রথম শর্ত হচ্ছে শিরদাঁড়া শক্ত করে, মাথা উঁচু করে প্রশ্ন করা| কিন্তু তা যেন আপনি না করতে পারেন সেই জন্যে আপনার ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে একটা অনাচারী ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্যেই বলা হবে আপনিই দোষী, আপনার চারপাশের সাধারণ মানুষ দোষী|

গোটা ব্যবস্থাটাই যখন জবাবদিহিহীন, তখন যাই ঘটুক ক্ষমতাসীনদের কেউই দায় নেবে না —  সেটা ডেঙ্গুর বিস্তার হোক, কি অব্যাহত ধর্ষণ হোক, কি প্রকাশ্যে খুন হোক, কি পিটিয়ে হত্যা হোক, কি বিচার বহিৰ্ভূত হত্যা হোক, কি গুম হোক| ঘুরে ফিরে এই দায় আপনার কাঁধেই তুলে দেয়া হবে| বলা হবে ‘আপনারা বদলালেই সব ঠিক হয়ে যাবে|’ এই ধরণের কথাবার্তাকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার, প্রশ্নবিদ্ধ করা দরকার -এখনই|

লেখাটি গত ২৮শে জুলাই, ২০১৯ তারিখে তাঁর ফেসবুক টাইম লাইনে প্রকাশিত হয়। লেখক ড. আলী রীয়াজ আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।
[লিখাটি শিরোনামহীন ছিলো, শিরোনামটি সংযোজিত]

Friday, May 22, 2020

কাশ্মীর এবং অন্যান্য মৃত্যুপুরী - ভূবন মুন্সী



"সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই" এ বঙ্গীয় বোধ-বাক্য ধারন, বাস্তবায়ন আজ পৃথিবীর অনিবার্য দাবী হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ পথ চলায় প্রাযুক্তিক সভ্যতা যে জায়গাটাতে খুব পশ্চাৎপদ হয়ে আছে তা মানুষ প্রসঙ্গ।

রাজনৈতিক মানচিত্র, জাতিগত মর্যাদা, গোষ্ঠীগত ও ব্যাক্তিগত মুনাফাকে সামনে রেখে চালিত সভ্যতা প্রতিনিয়ত পিঁপড়ের মতো পিষে ফেলছে মানুষ। যাঁদেরকে ঘিরে পৃথিবী সবুজ হয়ে উঠলো, সভ্যতা খোঁজে পেল টিকে থাকার যৌক্তিক সংজ্ঞা, তাঁরাই এক পর্যায়ে হয়ে উঠলো 'এক্সপেরিমেন্টাল ব্যাঙ', লেপ্টে গেলো দর্শনের কালো পৃষ্ঠায়।

আজ কাশ্মীর, কাল ফিলিস্তিন, পরশু রাখাইন; এভাবে চলতেই থাকে আফগান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া; এভাবে চলতেই থাকবে আর মরতেই থাকবে বোধ শ্রেষ্ঠ মানুষ।

বোধ শ্রেষ্ঠ হয়েও কেন এ বেহাল দশা?

মানুষ চাঁদে যায়, প্রতিবেশী আর বাড়ির লোক অনাহারে  মরে; মানুষ মঙ্গলে যায়, ঘরের লোক আত্মহত্যা করে; মানুষ সূর্যের দিকে ক্যাসিনো পাঠায়, সিরিয়া অনলে পুড়ে, পুড়ে যায় কাশ্মীর।

কেন এতো বৈপরীত্যে ঠাঁসা এক পৃথিবীর বুক?

সিরিয় শিশু আইলান কুর্দির জন্য, কঁচুকাটা হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য, ফিলিস্তিনিদের জন্য, ইরাক,আফগান আর কাশ্মীরের জন্য সেই কবে থেকে মানবিক আর্তি! কিন্তু মৃত্যু থামছেনা। যমদূত ক্লান্ত হলেই কেবল কিছুদিন মৃত্যু ঘুমিয়ে থাকে। বখাটে কুকুর গুলো প্রহরায় রাখে মানুষকে; মানুষ যেন না পালায়, যমদূত যেন পুনসংহারে মত্ত হতে পারে তান্ডব লীলায়।

সমস্যা কোথায়, সমাধান কোন দ্বীপে?

হাজারো ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য নির্মিত ও বিশ্লেষিত হয়ে মুদ্রিত ও পঠিত হলেও, মানুষ ও মানবীয় মর্যাদা থেকে গেছে অবেহেলায় কিংবা ভাসা ভাসা গুরুত্বে, কোন 'মানুষ সংবিধান' স্বাতন্ত্রিক মর্যাদায় মুদ্রিত, পাঠ্য ও পঠিত এবং চর্চিত হয়নি আজো; যতটুকু হয়েছে তা অন্য প্রসঙ্গের সাথে রিলেট করে, যেমন ব্যাক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানেও মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার, অধিকার ও মর্যাদা আলোচ্য ও চর্চিত হয়, মূখ্যত তা কোন ভাবেই মানুষের সাথে নয়, তা ভোক্তা ও ক্রেতার সাথে; এক্ষেত্রে মানুষ না হয়ে গরু যদি ক্রেতা বা ভোক্তা হতো, তাহলে তাদের সাথেও অনুরূপ ব্যবহার হতো।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ শুধুই মানুষ, মানুষ প্রাসঙ্গিকতায় মানচিত্রও অতিশয় তুচ্ছ বিষয়। মূলত একটি সজীব মানচিত্রই বর্তমান, আর তা মানুষের মানচিত্র। এ সাড়েতিন হাত মানচিত্রের মর্যাদার, তথা যৌক্তিক অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয়ে পরেছে আধুনিক বিজ্ঞাননিষ্ঠ সংবিধান এবং মানুষ  শব্দটা যেহেতু স্থানিক সীমা অতিক্রম করে বৈশ্বিক,  সেহেতু মানুষ অর্থেই সমগ্র পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন মৌলিক একক সংবিধান। স্থানিক বাস্তবতার ভিন্নতা, তথা বৈচিত্র্য প্রকৃতিগত শর্ত, তাই সংবিধানও হতে হবে প্রকৃতি উন্মোচিত জ্ঞান তথা বিজ্ঞানকে আধেয় করে মৌলিক পথে। প্রচলিত জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন বা ভাগের সাগরে স্নান করা পন্ডিতের পথ ও মত ক্যানভাসারের মলমের মতে গুণবতী শোনা গেলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে তা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

০৬.০৮.১৯

Thursday, May 21, 2020

অস্তিত্বের সন্ধানে - ন হন্যতে



আজ ২৫ এপ্রিল পহেলা রমজান, মা সন্ধায় ফোন দিয়ে জানিয়েছেন যেন ভুলে না যায়। আজকাল আর বেশি কিছু মনে রাখতে পাড়িনা, যেমন আজকেই মাগরীবের নামাজ পড়ে মার সাথে কথা বলে পড়তে বসেছি, মাথাটা ঝিমঝিম করছিল তাই ভাবলাম একটু বিছানায় রেস্ট নিই। অমনি ঘুম। যথারীতি মা ফোন দিল। কারন মাকে আগেই বলা আছে আমারে যেন ফোন দেয়, তা নাহলে আমার খাওয়া দাওয়া কিছুই হবেনা। ফোন ধরলাম বললাম আমারে মাগরিবের আগে ফোন দেওনাই কেন নামাজটা পড়তে পাড়লাম না? মা হাসছে।
আমি: হাসছো কেন?
মা: তুমিই না মাগরিবের নামাজ পড়ে আমারে ফোন দিলা! তোমার আব্বার সাথে কথা বলে পড়তে বসতেছো বলে ফোন রাখলা!
আমি: একটু জোড় দিয়ে বললাম ,আমি ভুলে যায় মানে কি সব ভুলে যায় নাকি?
মা: আচ্ছা ঠিক আছে, এখন সেহেরী খাওয়ার ব্যাবস্থা কিছু করছো নাকি ঘুমাইলেই চলবে?
আমি: সবি আছে শুধু কাঁচা মরিচ নাই।
মা: তাইলে এখন?
আমি: মরিচের গুরা আর শুকনা মরিচ আছে চালিয়ে নেওয়া যাবে আজকে।
মা: উঠে তারাবি পড়ে রান্না বান্না করে খেয়ে দেয়ে তাহলে ঘুমাও আমি আবার সেহেরির সময় ফোন দিবো।
বললাম আচ্ছা, খানিক পরেই মনে পড়লো তাইতো, আজকে প্রথম রোজা আব্বার সাথে তো কথা বলাই হইছে কারন মাস খানিক আগে মার সাথে কথোপকথন টা এমন ছিলো যে...
আমি: একটা কথা বললে বিশ্বাস করবে মা?
মা: বলো দেখি কথাটা কি?
আমি: তুমি যে আমাকে একদিন বলেছিলে "তুই শুধু পান খাস,তুই এইটাওইডা সবি খাস" মনে আছে?
মা: থাকবোনা কেন?
আমি: আমি না মা, ঐ এইটাওইডা খাওয়া বাদ দিছি।
মা: ভালো করছো ।
এইটাওইডার কাহিনী আরেক দিন লিখবো আপাতত এইটুকো জাইনা রাখেন যে এইটাওইডার মানে হচ্ছে সিগারেট।
মা: তুমি তো ছাড়লা তুমার বাপেরে কি করবা আমি: একিদিন সময় করে মাইনকার চিপায় ফেলতে হবো।
মা:দেখ কি কই?
তার সুত্র ধরে গত তিনদিন আগে বাপরে ফেললাম মাইনকার চিপায়..
আমি: মা কিছু বলছে আপনেরে,?
বাপে: বললো হুম
আমি: কি কইছে?
বাপে: আমি তুমারে যেদিন ধরছিলাম, ওই দিনই বলছে, রাতে যে ছেলেরে কেউ সামনাসামনি বলে? তোমার মা নাকি পড়ে তুমারে বুঝাই বলবে।
আমার বাপেও আমার মতো চাছাছুলা যা বলার সামনাসামনি...
আমি: অইটা পুড়ান কাহিনী নতুন কি কইছে?
বাপে: তুমি নাকি ছাইড়া দিছো..
আমি: তাইলে আপনি কি করবেন নিয়ত করলেন?
বাপে: আমি .আম..আমিই..
আমি: হ.হ.আপনি তো বুজলাম, কি করবেন?  বাপে: হুম আমি..
আমি: আচ্ছা তাইলে থাক, আমিও বাসার নিচে যায় দুই পেকেট নিয়া আসি একটা আপনার জন্য জমায় রাখমো আর আরেকটা আমি খাইতে থাকি, কি কন?
বাপে:রোজার শুরুতে বাদ দিমু।
তাই আজকে মাগরিবের পরেই ফোনে বাপকে চাইলাম, আব্বা কি জানি বলছিলেন মনে আছে? ফোন লাউড স্পিকারে ছিল মনে হয়, মা বলে উঠলো পাশথেকে, আজকে বিকালেও নিয়া আসলো এক প্যাকেট।
আমি: আব্বা তাইলে?
বাপে: এইটাই শেষ আর খাবো না।
আমি,আচ্ছা বলে ফোন রেখে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম এগুলাই মনে করতে করতে আবার ঘুম।
ভাংলো এক শুভাকাঙ্ক্ষীর ফোনে তাকে একটা ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য না করে কিছুক্ষণ কথা বলে এই সেই করতে করতেই দেখি  ১১টা বেজে গেছে। ভাবলাম তারাতারি রান্না করতে হবে। আগে ডিম আর আলু সিদ্ধ বসিয়ে দিয়ে নামাজ পড়ে ফেলবো, নামাজের দোয়া গেছি ভুলে মাকে ফোন দিলাম মা বলে দিয়ে বললো খাইছি রান্না করছি কিনা? বললাম হ্যা.
ফোন রেখে দিয়ে ভাবলাম মিথ্যা বললাম, মাঝেমাঝে আপনজনের দুঃশ্চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য দুই একটা মিথ্যা বলা যায়, কি বলেন?
নামাজ পড়াশেষ করে দেখি দুপুর বারোটা বিশ। তখনো খাওয়া হইনি, মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেদিন আপনার এলোমেলো যাবে কেমন যেন সব বিষয় এলোমেলো হবে, এই আজ দুপুরে ভাত রান্না করছি, শুকনো মরিচ তেলেভেজে আলুভর্তা করছি, ভাতেরমার গালতে গিয়ে বেশিরভাগ গেলোপড়ে অথচ এর আগে কখনো এই বয়সে কোনদিন এরকম হইনাই। বললাম আজ এই টুকোই রিজিকে আছে তাছাড়া বিকাল হতে বেশি দেরী নেই নাস্তা করে নিয়া যাবে বলে খেয়ে ঘুম।
ঘুমের পরের কাহিনী তো এতোক্ষন বক বক করলাম।
রান্না করলাম কাঁচা টমেটো আর সিদ্ধ আলু দিয়ে ডিম তরকারি, আর দুপুরের আলোভর্তা দিয়ে খেয়ে শেষ করে দেখি দেড়টা, ১.৩০ এএম।
ভাবলাম একটু পরেই তো আবার উঠতে হবে তার চেয়ে বরং একবারে সেহেরী খেয়েই ঘুমায় বলে গিয়ে বসলাম বেলকনিটাতে। কুকুর গুলো খুব বেশি চিল্লাচ্ছে আজ কিন্তু কাক টা আর কিচ্ছু বলে না কারন হয়তো বুঝে গেছে যে এই প্রাণীটি তার অস্তিত্বে ভাগবসানোর কেউনা নইতোবা আজ দিনের বেলায় বৃষ্টি হইছে ,কয়েক দিন থেকে দেখছি, সে ডিমে তা দিচ্ছে , হয়তো ঠান্ডাতে তার আগত সন্তানদের বেড়ে উঠায় বিঘ্নিত না হয় এ জন্য সে নাড়াচাড়া বা শব্দ কিছুই করছে না।
আমি ভাবতেছি বাহ কত কষ্ট করেই না কাকটা তার সন্তানদের এই অসুস্থ পৃথিবীতে নিয়ে আসতে আগ্রহী অথচ প্রতিনিয়তো দেখি দুই পাওয়ালা মানুষ গুলো, তাদের আগত সন্তানদের , রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে,পলেথিন ব্যাগে বা ময়লার ঝুরিতে ভরে. বাসার ছাদ থেকে নিচে কোন বস্তিঘর এর চালে , হাই কমোটের ফ্লাস মেশিনের চলন্ত পানির ধারায়...আরো অনেক অনেক..
তা হলে কি মানুষ আজ কাকের থেকেও নিচে?
আপনারা বলবেন সব মানুষ তো আর তা করছে না। তাহলে যারা করছে তারা, তাদের কি পা দুইটা না? চোখ দুইটা না? হাত কয়টা? তাদের মস্তিষ্কের ওজন কোন স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে কম? নাকি তাদের মস্তিষ্কের ওজন কাকের মস্তিষ্কের চেয়েও কম? তাহলে তারা কারা কোন গ্রহের বাসিন্দা??????
হ্যা ভালো মানুষও আছে, এই মুহুর্তে যে মা গর্ভবতী, হয়তো ডাক্তার দিনক্ষন সবি বলে দিয়েছেন যে, অমুক মাসের তমুক সপ্তাহে আপনার সন্তান এই পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে। সেই মা নিজেও হয়তো মিনতি করছে ঈশ্বরের কাছে যে আজকের এই অসুস্থ পৃথীবিতে যেন তার আগত সন্তানটা না আসে। সে হয়তো চাচ্ছে পৃথীবি সুস্থ হোক তার পর না হয় তার সন্তান আসুক।  হাহাহা.....কিন্তু সে জানেনা যে এই পৃথীবি কখনই সুস্থ হবে না কারন এখানে অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত অসুস্থ এক জাতি নাম মানুষ বসবাস করে, আর একটা অসুস্থ জাতির আবাসভূমি কখনই সুস্থ হতে পাড়েনা।
ভাবতে ছিলাম বেলকনিতে চেয়ারটায় বসে বসে মাথাটা আরো বেশি ঝিমঝিম করে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে.....
হঠাৎ তন্দ্রা কেটে গেলো, কেউ একজন ডাকছে বুঝতেছিলাম না কোন দিক থেকে, চেয়ার থেকে উঠে ঘরের ভিতররে দিকে যাবো এই মুহুর্তে আবার ডাক..খেয়াল করলাম নিচে রাস্তা থেকে ডাক দিচ্ছে, বললাম কে?
পাঞ্জাবী দেখে চিনতে পাড়ছেন না?
আমি: ল্যাম্পপোস্ট এর লাইট তো বন্ধ দেখা যাচ্ছেনা ঠিক মতো.
একটু ভালো করে দেখুন.
আমি নিচু হয়ে খেয়াল করে দেখলাম আশরাফ সাহেবের মতোই দেখতে...
আমি: এতোরাতে এই লকডাওন এর সময় আপনি কি করছেন অন্ধকার রাস্তায়?
সিগারেট খেতে মন চাচ্ছিলো কিন্তু কারও কাছে পেলাম না একটা সিগারেট দিবেন জনাব?
আমি: আমিতো ওটা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
ওহহো... ..
আমি: আচ্ছা আপনি আসলেন কোথা হতে? হসপিটাল থেকে।
আমি: কেন?
কিছুদিন আগে নহণ্যতে নামে এক ভদ্রলোক বুকের এক্সরে করতে গিয়েছিলো মিরপুর পপুলার ডায়াগনস্টিকে।
আমি চমকে গেলাম, আমার এক্সরের খবর এ জানলো কি করে?
বললো আপনার রিপোর্ট টা আনতে ভুলে গিয়েছিলেন আপনিতো এখন অনেক কিছুই ভুলে যান।
আমি: নাহ, আমার রিপোর্ট তো আমার কাছেই।
ওটা ভুল, অন্যজনের।
আমি: কেমনে?
হা..হা...হাসতে হাসতে বললো আপনি যেটার জন্য এক্সরে করিয়েছেন ডাক্তার সাহেব সেটা ভুল বুঝেছে। কিন্তু আমার চোখে তা ধরা পড়তে বাধ্য..
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আপনি দেখি সবি জানেন তো এতদিন কোথায় ছিলেন , আসেন নাই কেন?
বললো আপনি যেমন অসময়ে যতি বিহীন ইতি টানেন তেমনি আমিও ইতির পরে আবার শুরু করি যতি চিহ্ন দিয়ে ইতি টানবো বলে।
আমি: রিপোর্ট টা দিবেন কেমনে, মেইন গেইট তো বন্ধ?
বললো ব্যাপার না আমি রিপোর্ট দেখেছি আপনি যা ভাবছেন ঠিক তাই আছে একদম গুনে গুনে দেখেছি।
আমি: মানে?
হাহাহা..
আপনার বাম পাঁজর আর ডান পাঁজর কোন পাঁজরেই হাড়ের সংখ্যা কম বেশী নেই।
আমি: বিজ্ঞান কি সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারবে? ?
বললো এতদিন ধরে দিয়ে আসছে
আমি: এই যে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন এই মাঝ রাতে এটা কিভাবে ব্যাখ্যা দিবে বিজ্ঞান?
কিছুক্ষন চুপ করে বললো আজকে কুকুর গুলো বেশি ঘেউ ঘেউ করছে তাই না?
আমি: হ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
বললো এটার কি ব্যাখ্যা দিবেন?
আমি: ভাবতে হবে..
বললো ভাবেন রিপোর্ট টা ততোদিন আমার কাছেই থাকলো আবার দেখা হবে অসময়ে..আমি ভাবছি তাইতো কুকুর গুলিতো এতো রাত অব্দি চিল্লায় না তাহলে আজকে এতো চিল্লাছে কেন তাহলে তারা কি??
মনে পড়তেই ডাকলাম....জনাব..?
নিচে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই আরো কয়েক বার ডাকলাম কুকুরগুলিও কেন জানি শান্ত হয়ে গেলো নিরবতা আবার চেপে বসলো মোবাইলের ঘড়িতে দেখি রাত ২.১৬.
ভাবলাম ভিতরে গিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ টা পড়েই ফেলি অজু করতে গেলাম ওয়াশরুমে শব্দ শুনলাম মোবাইল বাজে ফিরে এসে দেখি মা এর মধ্যে তিনবার ফোন দিয়ে ফেলেছে।
ফোন দিয়ে বললাম ঘুমাইনি খেয়েদেয়ে একবারে ঘুমাবো। মা বললো আমি আরো ভাবলাম ঘুম থেকে উঠতে পাড়লে কিনা?
আমি মুচকি হাসি দিয়ে মনে মনে বললাম চাইলেই কি ঘুমানো যায়..?
ঘুমকে আমার কাছে আসতে হয় অনেকটা পথ পারি দিয়ে পায়ে হেটে এই লকডাওনের রাতে...খাওয়া শেষ করে নামাজ পড়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছি ব্যাখ্যা দিবো কিভাবে...??

২৫.০৪.২০২০

মানচিত্র কথা - ভূবন মুন্সী



ভাগাভাগির মানচিত্র যা বর্তমান বেনিয়া ভুবনে, তা চিতার অনলে পুড়িয়ে দিলে বেঁচে থাকে দুটো মানচিত্র মানুষের পৃথিবীতে। একটি সাড়ে তিন হাতি মানুষের মানচিত্র এবং অপরটি সকল জীবকে ধারণ করে ধরিত্রী অর্থে বসুমাতার মানচিত্র।

মানুষের মানচিত্র ইউনিক এবং অনেক, আর সে মানচিত্রের মান ঠিক রাখার শর্তে আদি হতে আগামীর দিকে বয়ে চলা যত সংগ্রাম এবং অসংখ্য ইউনিক মানচিত্র সংহত করার প্রশ্নে বসুমাতার বুক চিড়ে তুলে আনা নিয়ত ঋদ্ধ কোড বা বিধান।

মূলত মানুষের মানচিত্রের অখণ্ড রূপ প্রকাশেই ভুবনের মানচিত্র অঙ্কিত এবং তা মানুষকে এগিয়ে নিতে ও যাপনকে সহজ করতে অর্থাৎ ব্যাবস্থাপনার শর্তে। আর সে ব্যাবস্থাপনাকে সহজ করতেই প্রয়োজন পড়ে Based on Ecology ভিত্তিক পাড় বা কাঁটাতারহীন গাণিতিক রেখার অর্থাৎ  Political Geometry এর স্থলে Ecological Geometry। এটাও প্রয়োজন মানুষের মানচিত্রকে ক্রমত্তোরিত পথে এগিয়ে নিতে এবং এ Based on Ecology ভিত্তিক শর্তটাই কাশ্মীর, আরাকান, ফিলিস্তিন বা তৎসদৃশ অপরাপর বৈশ্বিক সংকট সমাধানের sin-qua-non বা অপরিহার্য শর্ত।

Historical sign বা ফসিল এবং Historical line বা ইতিহাস হতে প্রাপ্ত দৃশ্যে আমরা দেখি একদিন মানুষের হাত, পা, গলে শিকল ছিলো। মানুষ মানুষকে দঁড়িতে বেঁধে বাজারে বিকাতো। দৃশ্য বদলে গেলেও বর্তমান দুনিয়া in situ অর্থে তার আদি আচরণ হতে বেরুতে পারেনি। তাই বেনিয়া স্বভাব ভাইপার হয়ে আজও বিষিয়ে যাচ্ছে বসুমাতার মানচিত্রে জেগে থাকা মানুষের প্রাণ।

যে অর্থে লেঠেল সর্দার, সে অর্থেই বেনিয়া সরকার এবং বুদ্ধির দ্বার যাদেরকে ভাবি তারাও পাড়ার মোড়লের খোয়াড়ে জন্ম নেয়া অর্বাচীন অসাড়- প্রকাশিত পৃষ্ঠার গায়ে সংগ্রামহীন ছন্দ, সস্তা জৈবিকতার দ্বৌরাত্ব, নটিপনা আর tete-a-tete.

Greenroom Politician গণ জনপদ ভুলে গিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে vox dei বয়কট করা অর্থে ভোট চুরি করে লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি কায়েম করছে, তথা pro forma অনুযায়ী সমাজগত জাহেলিয়াতকে উস্কে দিচ্ছে। কারণ অনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য জাহেলিয়াত কায়েম ও জিইয়ে রাখাটা আবশ্যক; নারকীয় temperature ক্রমশ সয়ে, জীবনের নির্মোক আঁকড়ে পড়ে থেকে জনগণ একসময় হয়ে যায় Boiling Frog, তখন মধ্যযুগীয় servility টের পেলেও জাম্প করার সক্ষমতা তাদের থাকেনা।

veni, vidi, vici শর্তটা গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের রাজ্য জয়ের ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও সমাজ বা সামষ্টিক মানুষের বদল রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে che sara sara মনোভাব নিয়ে আমরা যারা বসে থাকি অথবা সমস্যার সমাধান কল্পে মন মন্দিরে নিত্য জপি চিচিং ফাঁক - মিলবে কি মানচিত্রের গায়ে সেঁটে থাকা খোস পাঁচড়া তাড়াবার নিমপাতা?

তালপাতার সেপাই দিয়ে তুলসী বনের বাঘ যেমন তাড়ানো যায় না, তেমনি সংগ্রাম ও সংগ্রামী ছাড়া সমস্যার সমাধানও করা যায় না।

ভাগের প্রাচীর, স্বার্থের কাঁটাতার উপড়ে দিয়ে অখণ্ড বসুমাতার মানচিত্রে সাড়ে তিন হাতি মানচিত্রের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংবিধান রচনাই হবে এ সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ সৃজন কর্ম।
V-sign প্রদর্শন তখনই যথার্থ।

২১.০৫.২০২০

Wednesday, May 20, 2020

মহামারী থেকে শিক্ষা - এম. ইকবাল



আমাদের দেখা এই প্রথম সমগ্র পৃথিবীতে একই সময়ে সব মানুষের মধ্যে প্রাণ হারানোর ভয়, আতংক বিরাজ করছে। কি হয় শেষ পর্যন্ত, কতজন মানুষের মৃত্যু হয়, কিভাবে এর মোকাবেলা করা হবে, এই সব কিছুই এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে আছে। সমগ্র দুনিয়া আজ কোভিড ঊনিশ এ আক্রান্ত।   । 

পৃথিবীর মোড়ল দেশগুলোসহ সবগুলো আক্রান্ত দেশই অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউরোপ, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ও এশিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর লকডাউন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় এসব শহরের বাসিন্দাদের ঘরে খাবারসহ, পানীয় ও ঔষধ  সরবরাহ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে দুনিয়াজুড়ে জরুরী অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সব রাষ্ট্রগুলোর ব্যবস্থাপনার অসাড়তা বেরিয়ে আসছে। একমাসের জন্যও মানুষকে ঘরে রেখে খাবার ও চিকিৎসা দিয়ে টিকিয়ে রাখার অবস্থা রাষ্ট্রগুলোর নেই। যদিও দু'একটি রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্বপ্রাপ্তরা অন্ততঃপক্ষে এভাবে ১ মাস জনগনকে হোম কোয়ারান্টিনে রেখে ঝুঁকিমুক্ত হওয়া পর্যন্ত সকল সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষনা করেছে। সেটাও একান্তই ব্যাক্তিগত মানবিকবোধের জায়গা থেকে এক ধরনের চেষ্টা ও চ্যালেন্জ। সেক্ষেত্রে কানাডা'র প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের ঘোষনা দিয়ে পৃথিবীবাসীর কাছে মহামানবীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেটাও কতটুকু সফল হবেন তার উপর ভরসা না করেই শুধু মানবীয় গুনাবলীর দিক দিয়ে জনাব জাস্টিন ট্রুডো মহামানবের সীমানায় পৌঁছেছেন।

কোন ধর্মীয়, অধর্মীয়, প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে এই মহামারীকে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বানের জলের মতো সবার ঘরেই ঢুকে পড়ছে ভাইরাস আতঙ্ক। স্রষ্টার কাছে মুক্তি চেয়ে সাময়িক মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমলেও শেষ ভরসায় রাষ্ট্রগুলো তাকিয়ে আছে সাইন্স-ল্যাবরেটরি গুলোর দিকে।

এই মহামারী থেকে আমরা আসলে কি কি শিক্ষা পেতে পারি?

১. পৃথিবীজুড়ে বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বর্তমান চ্যালেন্জ মোকাবেলায় কতটা অসাড় তা দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনা মহামারী। সেই সাথে সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরী সেটাও এই জরুরী অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

২. ধর্মীয় বিধিবিধান, রীতিনীতি, অনুষ্ঠান, যা মানতে বা পালন করতে গিয়ে আমরা মানুষ ও মানুষের জীবনকে তুচ্ছ করি, আজ জীবনের প্রশ্নে সকল ধর্মের বিধিবিধান, রীতিনীতি ও অনুষ্ঠান আয়োজন থমকে দাঁড়িয়েছে। এটাই ঠিক যে জীবনের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য জীবন নয়। এছাড়া এটাও প্রমান হয় যে মানুষের সংকটে ধর্ম স্বয়ং আক্রান্ত হয়, আর যা কিছু নিজেই আক্রান্ত হতে পারে তার অন্যকে বাঁচানোর ক্ষমতা খুব বেশি নেই।

৩. স্রষ্টাবিশ্বাস মানুষের আত্ববিশ্বাসকে বৃদ্ধি করে এবং মানুষের মানসিক অস্থিরতা সাময়িক ভাবে দূর করে। জীবন ও যাপনের প্রয়োজনে মানুষ শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানকেই অবলম্বন করে এবং ল্যাবরেটরিতেই আস্থা রাখে।


১৯.০৩.২০২০

মার্কেটিং এর যুগ : প্রচারেই প্রসার - ভূবন মুন্সী



জীবন হলো অল্প তাপের আগুন। এতো অল্প তাপের অধিকারী হয়েও যারা দাবানল সৃষ্টি করতে পারে বা পারমাণবিক আগুনে হিরোশিমা নাগাসাকি ছাই করে দিতে পারে তারাই মানুষ। কেমন মানুষ? ভালো না মন্দ?

যে জীববিজ্ঞান জীবনকে অল্প তাপের আগুন বলে জানে তার কাছে ভালো বা মন্দ বলে কোন মানুষ নেই। কারণ চোর ডাকাত ঠগ প্রতারক বা দাতা ত্রাতা দেবতাদের  DNA নকশায় এমন কোন কোড নেই যার কারনে তারা বদমাস ইতর বা দেবত্বের তকমা পেতে পারে। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান আমাদের সাহায্য করে। যুগ বাস্তবতা বা সময়ের নিক্তিতে সে তার ইথিক্স মোরালিটি আউটলুক দিয়ে বা দর্শনগত সীমারেখা টেনে ভালো বা মন্দের বাটখারা নির্মান করে থাকে।

বর্তমান সভ্যতা বাজারী সভ্যতা: সমাজ এখন বাজার আর ব্যাক্তি হচ্ছে  ভোক্তা। মুনাফা অর্জনই অর্থনীতির একমাত্র সুর। প্রাণের চেয়ে পুঁজির গুরুত্ব বেশি।

আমরা যদি মার্কেটিং এর যুগ থেকে একটু পিছনে যাই- কলোনিয়াল যুগে: মানুষের হাতে মৃত্যু প্রাপ্ত হয়েছে অগণিত মানুষ, বাজার দখলের তাড়নায় তাদেরকে দেখেছি গেঁয়ো কুত্তার মতোন কামড়া-কামড়ি, বৈশ্বিক যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ- খোদ ভারত বর্ষেই কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু।

প্রযুক্তিগত উত্তরণ কলোনির রূপটাকে বদলে দিয়েছে, একদম হ্রাস করেছে পারমানবিক যুদ্ধের শঙ্কা ত্রাস। নয়া বাস্তবতায় বিজ্ঞাপন দখল করেছে যুদ্ধের কাজ। বিজ্ঞাপন মারফত মনন তৈরি করে, অতপর তৈরি হয় নতুন চাহিদা, তদানুযায়ী যোগান; অধিক চাহিদা, অধিক বিক্রি, অধিক মুনাফা অর্জন।

মার্কেটিং এর এই যুগে মানবতা কিন্তু দৌড়ে পালিয়েছে। যেমনটা শুনি- সুবোধ তুই দৌড়ে পালা কিংবা এখন তোর সময় না। আসলে সময়টাই মার্কেটিং এর। মানুষ মেতে আছে প্রচারেই প্রসার স্লোগানে। জ্ঞান এখন দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নগদ টাকা আসবেনা এমন কাজ গুলো অর্থহীন হয়ে উঠেছে। সব চলছে ডিম্যান্ড এন্ড সাপ্লাইয়ের ভিত্তিতে। যে ডিম্যান্ডই হোক না কেন - অস্ত্রপাতি কিংবা পর্ণোগ্রাফি আপত্তি নেই।

ন্যায়সঙ্গত এবং পরিবেশ বিজ্ঞান সম্মত নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো আমাদের খোঁজতে হবে। শুধু মুনাফা কেন্দ্রীকতায় আমরা জন্ম দিয়েছি 'আজাইরা কাজ' আর 'বেহুদা পণ্য'। ধর্ম, মাতৃত্ব, সুবোধ, দেশ প্রেম কিংবা মানবতা সবকিছুই বাজারে তুলেছি বিজ্ঞাপন মারফত পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্য; ঐতিহাসিক আদর্শিক চরিত্র, এমনকি প্রফেটদেরকেও বাদ রাখিনি। সমাজটাই বাজার আর সব মানুষ খদ্দের।

ভালো বা মন্দের তুলাদণ্ড এখন টাকা। দান ত্রাণ যা কিছুই করিনা কেন সব কিছুতেই বিজ্ঞাপনের ছোঁয়া, প্রচারেই প্রসার। ধান কাটার দৃশ্যকে বাজারী বিজ্ঞাপন স্টাইলে প্রচার ব্যাবসা বৃত্তিক মনোভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে কিংবা উল্টা পাল্টা ওয়াজ নসিহত বা বক্তব্য প্রদান করে ভাইরাল হবার চেষ্টা মূলত বাজার দখলের চেষ্টা বা প্রচারেই প্রসার নীতির অনুকরণ।

ডান হাত দান করলে বাম হাত না জানার কথা অথচ তাদের ভঙ্গিমা... প্রফেট বর্তমান থাকলে বিস্মিত হতেন শান্তির অনুসারীদের দেখে। ডান গালে চড় মারলে বাম গাল পেতে দেওয়ার কথা থাকলেও অর্থের জন্য অস্ত্র নির্মাণ, বাজার দখলের নামে যুদ্ধ- যিশু বেঁচে থাকলে অভিসম্পাত করতেন। পুরনো পরম্পরার শৃঙ্খল দেখে বাসুদেব পুনরায় 'যুদ্ধ' আরম্ভ করতেন।

'নতুন যুগ' সমাগত। 'পুরাতন' বিদায় না নিয়ে শৃঙ্খলার বেড়ি হয়ে সেঁটে আছে সভ্যতার গলায়, জোয়াল হয়ে দাবিয়ে রেখেছে সমাজের স্কন্ধ।

রাত ক্ত্ত হইলো? উত্তর মেলেনা। রাত পোহাবার কত দেরী? উত্তর মেলেনা। মাঝি বেঘোরে ঘুমায়া থাকে। কিন্তু সময়তো থেমে নেই। 'নতুন' প্রসবের প্রাণান্ত চেষ্টা সময় নিজেই করছে: জলবায়ুর পরিবর্তন কিংবা ঘন ঘন ভাইরাসের প্রকোপ, অতপর বারবার প্যানডেমিক, এসব কিছু ভিন্ন কোন অর্থ বহন করে কী?


০৫.০৫.২০২০

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও স্থানীয় শাসন প্রসঙ্গে - আব্দুল আলীম





ভারত উপমহাদেশে বাংলা ছিলো প্রদেশ। ১৮৮৫ সালে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর  সহায়তায় কংগ্রেস নামে রাজনৈতিক দলের  উদ্ভব হয়, যা হিন্দু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়। যার ফলশ্রুতিতে মুসলমানগন তাদের স্বার্থরক্ষার্থে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে। এভাবে গোটা ভারতবর্ষের জনগণ এ দুটো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে যায়।

(এ দুটো রাজনৈতিক দল তৈরির ন্যাপথ্য নায়কের ভূমিকা ছিল বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর। বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শাসন কার্য যথাযথ পরিচালনা করার জন্যই উল্লিখিত রাজনৈতিক দল দুটি গঠন করেছিল। যা মূলত তাদের স্বার্থে তাদের জন্য গড়া।এদের জনসমাজ তথা এদেশের মানুষের স্বার্থের বিপরীতে ছিল।)

তখন থেকেই হিন্দু মুসলিম নিজেদেরকে দুটি আলাদা জাতি হিসেবে ভাবতে থাকে এবং দাবি আদায়ের প্রশ্নে আন্দোলন সংগ্রাম করতে থাকে। এভাবে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দুইভাগে ভাগ করে পাকিস্তানের দায়িত্ব অর্পণ করে মুসলিম লীগের হাতে এবং ভারতের দায়িত্ব অর্পিত হয় কংগ্রেসের ওপর।
তখন থেকেই ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ রোপিত হয়। যে বিষবৃক্ষের ফল এ দেশের জনসাধারণ এখনো ভোগ করছে।

আমার আলোচনা এখানে নয়, আলোচনা হচ্ছে বৃটিশ শাসন সাপেক্ষে ভারতবর্ষ ছিল প্রদেশ আর এদেশের জনসাধারণ ছিল সাধারণ প্রজা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সাপেক্ষে বাংলা ছিল প্রদেশ। সেই বৃটিশ শাসনামলে এ ভারতবর্ষের জনগণের প্রধান দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এ দাবি আদায়ের প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্মিলিত ভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। এ কারনে বৃটিশ শাসক ১৯৩৫,১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালের  ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও মূলত বাস্তবায়িত হয়নি।

পাকিস্তান সাপেক্ষে বাংলা তথা পূর্ব বাংলা,পাঞ্জাব,সিন্ধু,বেলুচিস্তান ইত্যাদি ছিল প্রদেশ।
তখন বাংলার জনগণের প্রধান দাবি ছিল পূর্ব বাংলা তথা বাংলার স্বায়ত্তশাসন। যে কারনে বাংলার জনগন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা প্রদেশ আলাদা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলার জন্য আলাদা অর্থনৈতিক ফান্ড গঠন। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দেশের মালিক ছিল বিদেশি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশের জনগণ তার স্বত্তাধিকারী ফিরে পেলেও বাংলা এখনো বাংলার হয়ে ওঠেনি।
বাংলার জনগনের সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন তথা মনোবাসনা অপূরিত থেকে গেছে।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন সেই স্বপন অপূরিত রয়ে গেল?  বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিল বা আছেন ঐতিহাসিক বাস্তবতায় স্বাধীন বাংলার রাজনীতি কেমন হওয়ার কথা ছিল তথা কি ধরনের শাসন ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল। ধর্মের জন্য ধর্মীয়গ্রন্থ তেমনি রাজনীতির জন্য ইতিহাস। আমরা ইতিহাস থেকে দেখতে পাই বৃটিশ শাসন ও পাকিস্তান শাসনামলে এদেশের জনগনের মুক্তির প্রধান দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে প্রদেশের জনগন দ্বারা প্রদেশ পরিচালিত হবে। মূলত প্রদেশের অর্থ দিয়ে প্রদেশ চালিত হবে। একটা অংশ কেন্দ্রে যাবে কেন্দ্র তথা গোটাদেশ পরিচালনার জন্য। আজকের স্বাধীন বাংলায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে স্থানীয় শাসন।মূলত পূর্ব থেকেই মানুষ স্থানীয় ক্ষমতা তথা স্থানীয় শাসন বাস্তবায়নের জন্যই সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে জনগনের এ দাবিটি অন্তরালে থেকেছে না হয় শাসকগোষ্ঠী জেনে বোঝেই জনমনের এ দাবিটি অন্তরাল করেছে।

স্থানীয় শাসন বাস্তবায়নই হবে স্বাধীন বাংলার রাজনীতি তথা এদেশের মানুষের ঐতিহাসিক দাবি। স্থানীয় শাসন তথা সংবিধানের ৬০ ধারা বাস্তবায়নই হবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলার বর্তমান রাজনীতি।

২০.০৫.২০২০

এশক - ভূবন মুন্সী




১.
আইন শিন ক্বাফ এর ভেদ না জেনে
পাবে কি মন আলিফ লাম আরা মিমের দিশে,
তালাশ কর মিম জিম আর নূনের বেশে।

২.
কালের কথা ভাবছো কেন
মুহুর্ত গুলো প্রেমে কাটাও
আর কি আছে প্রেম ছাড়া
তুমি নিজেই প্রেমে সৃষ্টি।

৩.
সে কোথায় থাকে দিল ছাড়া
পিওর প্রেমিকের দিল মশগুল
তাঁকে কে বুঝে প্রেমিক ছাড়া
চেয়ে দেখো সুন্দর কত কাশফুল। 

৪.
তামাম দুনিয়া চষে বেড়াও
বুক ভরে নাও প্রেমের স্বাদ
আর কি নিতে পারো, এটা 
খোদার প্রেরিত সংবাদ।

৫.
শুদ্ধ থাকো এবং ঋদ্ধ হও
এশক ছাড়া কি আছে এমন
ঋদ্ধ করে?
কু এশক ভিন্ন অন্য ঘরে।

৬.
কে তুমি প্রশ্ন করো নিজেকে
দেখবে তুমি কিছু না
কিছু নও
ছিলেনা কিছু প্রেম ছাড়া। 

৭.
সুরা হারাম ছিলো
তার জন্য ক্লিনিক্যালি জায়েজ 
শামস ভাবতো না কিছু 
দৃশ্যটা আপেক্ষিক। 

৮.
যে চোখে নিজেকেই পাও না
কিভাবে তাকে দেখবে
এশকের চোখে খোঁজ
সেখানে অমা পূর্ণিমা নেই।

৯.
সে অন্ধকার এবং
তুমি আলোকিত করতে পারো
যতটুকু তুমি
তার চেয়ে সে বেশি নয়।

১০.
বাহির বন্ধ কর
তালাশ কর ভিতরে
এটা সরল পথ।

১১.
নীরব থাকো
শব্দের ঘরে নিঃশব্দে ডাকো
তিনি সন অব সাইল্যান্স
জাগাও।

১২.
কেউ কি বাঁশি বাজায়
কার বাঁশি কে বাজায়
বাশি সব বলে বাক্যহীন
সুরের সাথে রাত্র দিন।

১৩.
চাঁদের আলোয় তাকে দ্যাখো
সে না চাঁদ, না আলো
এশকের চোখে তাকাও
তাকে দ্যাখবে।

১৪.
সে কোথায়
প্রশ্ন করোনা 
শুধু ডুব দাও অতলে
প্রেমের গভীর জলে।

১৫.
নিজেকে খোঁজ
জ্ঞান দিয়ে হয় না খুব
প্রেমে মজ।

১৬.
কিছুই না 
নীরবতা একটি স্লেট 
যেখানে দেখতে পাবে
স্রষ্টার ছবি।

১৭.
বৃষ্টির ফোঁটাকে দেখো
সে কি বলে?
অন্যটির জন্য কান্না করে
জল হতে চায়।

১৮.
চেষ্টা করো না
অনুরাগে অপেক্ষা করো
সে দ্বার খুলবে
স্বেচ্ছায়।

১৯.
ভেদ করো না
সে সর্বত্র
এবং তুমিও
চেয়ে দ্যাখো।

Tuesday, May 19, 2020

দায়বদ্ধতা, দেবত্ব কিংবা আসুরিকতা৷ - ভূবন মুন্সী

দায়বদ্ধতা, দেবত্ব কিংবা আসুরিকতা

ভূবন মুন্সী
মেসেঞ্জার অব কসমোলজি 



“স্বার্থগত ভেদবুদ্ধি বৌদ্ধিক সত্যাচারকে রুদ্ধ করে” - এ পথ ধরে সুশীল, ‍বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক কিংবা শিক্ষিত শ্রেণি স্বার্থবাদিতার তুমুল ঝোঁকে আজ অন্ধের মতোন বিকারগ্রস্থ সম্প্রদায়। নিরক্ষরতা যেহেতু মূর্খতা নয়, অক্ষর জ্ঞান বা স্বাক্ষরতাও সভ্য সমাজের যৌক্তিক দন্ড হতে পারেনা, আর পারেনা বলেই অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন প্রচলিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সাংখ্যিক সম্প্রসারন ঘটলেও সমাজ বা রাষ্ট্রিক বাস্তবতা এই বলে যে, নারকী সংকট বিষবাষ্প মেঘ হয়ে ঢেকে রেখেছে আমাদের যাপন আকাশ, আবছায়া অন্ধকার নামিয়ে এনেছে সমগ্র দেশে, বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে মৃত্যুর সুর। হল্ট, থামো এবার!

দায়বদ্ধতা যাদের কাঁধে, তাদের পক্ষ থেকেই দায় নেওয়া, না নেওয়ার প্রসঙ্গ থাকে বা তাদের মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসে দ্বায়িত্ব পালনের অগ্নি শপথ অথবা নির্লজ্জের মতো মিউ মিউ কন্ঠে বেরিয়ে আসে- এ দায় আমি-আমরা নেবো না। দায়বদ্ধতার পদে আসীন থেকে দায় না নেওয়া যেমন বেইমানী, তেমনি দায় পালনে অক্ষম হলে পদত্যাগ করা বা সবাইকে সাথে নিয়ে দায় পালনে সচেষ্ট হওয়া বৌদ্ধিক সচেতনতা এবং সততাকে প্রকাশ করে। কিন্তু চলমান সামাজিক, রাষ্ট্রিক সংকটে দায় এড়িয়ে খরগোশের মতোন ঘাসে মুখ লুকানোর অভ্যাস বেড়ে গেছে, সেই সাথে বেড়ে গেছে দায় অস্বীকার করে বেইমানীর প্রবনতা। বেইমানদের শত ধিক, ছিঃ!

“প্লে থেকে পিএইচডি- যেমন কোথাও নেই আমার দেশটা”, তেমনি প্রাইমারীর কক্ষ থেকে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস- সর্বত্র এক ইতিহাস বিমুখ নির্লিপ্ত প্রজন্ম নিয়ে আমরা সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছি। আর এ ইতিহাস বিমুখ তরুনরাই বয়োবৃদ্ধদের ভেলকিবাজিতে আজ কারাগারে নয়তো অন্ধকার কবরে, মারে কিংবা মরে। এ ইতিহাস বিমুখ সংকীর্ন কন্ঠ থেকেই বেরিয়ে আসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী, অথচ এ অধিকার আদায়ের প্রশ্নে প্রাণ দিয়েছে আমাদের পূর্বজ, আমাদের পিতা। একি বিস্ময়!

মানচিত্রের ক্যানভাসে নিয়ত বেড়ে চলছে ভীবৎষ মৃত্যুমুখ, নৈতিক স্লেট ক্ষয়ে যেতে যেতে এখন শূন্য প্রায়, নৈতিকতা পরিবার ও পাঠশালা থেকে বিদায় নিয়ে সেঁটে আছে বইয়ের পাতায়, ভোরের অযান ছাপিয়ে উচ্চে আজ ধর্ষিতার ঘোঙানির সুর, কাসার ঘন্টা স্টপ হয়ে আছে-সন্ধ্যা হলেই বেড়ে যায় আসুরিক চিৎকার...তবে কি আমরা এখানেই শেষ? নাকি কিছু করার আছে? আছে কি?

আন্ডার গ্রাউন্ডের ডন আর অভিবাবকত্বে থাকা নেতা কিংবা শিক্ষকের ‘কন্ঠ ও কর্তব্য’ যখন এক রূপ ধারন করে, ‘আস্তানা আর অঙ্গন’ যখন তফাৎ ঘুচিয়ে নেয়, তখন ‘আমি আছি’ বা ‘লাব্বাইক’ বলতে পারা তরুনদেরই জাগতে হয়, জেগে উঠতে হয় ভোর প্রত্যাশী মায়ের ডাকে, তারুণ্যের মেজাজে জাগাতে হয় স্বার্থের মদে মগ্ন, তন্দ্রাচ্ছন্ন আপন জাতিকে; যাদের সাথে জড়িয়ে থাকে আমাদের ভালো বা মন্দ থাকার শর্ত, যাদেরকে সাথে নিয়েই আমরা আমাদের যাপনের সংবিধান লিখেছিলাম এবং যাদেরকে সাথে নিয়েই রচনা করবো আগামীর যথার্থ সংবিধান।

১৯.১০.১৯

Monday, May 18, 2020

কার ঘরে কে আগুন ধরায়? - মোঃ শামীম রেজা




রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর, খাতা-বইপত্র, বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো হয়নি বরং বাংলাদেশের আত্মা পোড়ানো হয়েছে। গত চল্লশি বছর ধরে যে ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছিল তার পূর্ব ধারার পরম্পরা হিসেবে, যা বাঙলার একেবারে ভিতরের শক্তি। সমাজের কোষকে রক্ষা করে যে ধারা-সংস্কৃতি, শহুরে ভাষায় যাকে বলা হয় ঐতিহ্য তাকে যদি পোড়ানো হয় তো সে সমাজের থাকে কি?

কিন্তু এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কিভাবে? কোন দর্শন, কোন বোধ, কোন রাজনৈতিক চেতনা সমাজের ভিতরেই এমন ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে ফেললো?

রণেশ ঠাকুর বলতেই পারছেন না তার এমন কোন শত্রু আছে যে কিনা তার গানের ঘরটাই আগুন দিতে পারে। এটা তো আরো ভয়ংকর যে শত্রু চিহ্নিত নয় অথচ শত্রুতার স্বীকার হতে হলো তাকে। প্রকৃত অর্থে এই আগুন বাংলাদেশের সেই সাধনার ঘরে লাগানো হলো যেখানে জন্মহয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার, যেখানে লালন পালন হয় সেই পরম সত্যের যে বলে " তন্ত্র মন্ত্র করে দেখি তাহার ভিতর তুমি নাই শাস্ত্র গ্রন্থ যত পড়ি আরো দুরে সরে যাই, কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে"।

শাস্ত্র-গ্রন্থের যে মৌল আচার তাকে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে, এবং ভক্তিবাদের যে কথা বলা হচ্ছে সেটা বাঙলার একেবারে নিজস্ব শক্তি। শক্তিই বলতে হয়। আজকের পৃথিবীতে মানুষ যখন শুধু বস্তুবাদী জ্ঞানের সন্ধান করে নিজেকে জড় বস্তুর অনুগামী করে ফেলছে, পারস্পারিকতাহীন, অবিশ্বাসের কানাগলির ভিতর প্রতিনিয়ত ঘোর-পাক খেতে খেতে জীবনকে শুধুই একটা ভারবাহী যন্ত্র বানিয়ে ফেলছে সেখানে এই ভক্তি আর প্রেম ছাড়া মুক্তি কোথায় এই যান্ত্রিকতা থেকে? আগামীর পৃথিবীতে রাষ্ট্র বলতে তো একটা বিশ্বাসের সীমানা হয়ে থাকা ছাড়া তার অস্তিত্ব কোথায় সীমানাগত অর্থে?

কিন্তু ব্যবস্থাপনা তো থাকবে।


সবচাইতে বড় সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বায়নের এই যুগে লোকাল আইডেন্টিটি নিয়ে
যে জ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে বিশ্বায়নের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রযুক্তির হাত ধরে কেন্দ্রমুখি অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেই জ্ঞান বা দর্শন  কি পৃথিবীর বিকেন্দ্রে থাকা মানুষগুলোর জীবন ব্যবস্থায় তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছে? বরং এই দর্শন কাঠামো তাদের প্রাণ থেকে শুষে নিয়েছে তাদের প্রাণ শক্তি্ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত করেছে অসংখ্য প্রাণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিনিময়ে অংশীদার করেছে বিভিন্ন রোগ, মহামারী, পরিবেশ দূষণের, মত মহাপাপের। আগামীর পৃথিবী তে লোকাল সংস্কৃতি, আচার,বিশ্বাস এই কেন্দ্রমুখী মৌল ব্যবস্থার প্রতিরোধক হতে পারে। কারণ তা প্রকৃতিসম্মত হয়েই ভারসাম্য নিয়ে গড়ে ওঠা।


 বাংলাদেশের প্রাণশক্তি কোথায়? কোথায় তার শিকড়? কেন অধিকাংশ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও বহু চেষ্টার পরও এখানে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদীতা ভিটে পায় না?  প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেদের প্রশ্নেই খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঘরে আগুন জ্বললো বলে দেখা গেল তা নেভানোর চেষ্টাও করা হলো (যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে)। কিন্ত যে হৃদয় এই খাতা পত্রের চর্চা করতো সে কি আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারবে নাকি চাইবে? পুড়ে যাওয়ার ভয় কিংবা আতঙ্ক তাকে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি রেখে দুঃস্বপ্নের বেদনার মত ছুটিয়ে বেড়াবে না তো? যে বাদ্যযন্ত্র গুলো পরম মমতায় সাড়া দিত যে হাতের স্পর্শে, সে হাত আর বেজে উঠতে চাইবে কি?
এসবের কোন উত্তর আমাদের জানা নাই।  একজন রণেশ ঠাকুর কে বাংলাদেশের অসম্প্রদায়িক চেতনার দুর্গ হিসেবে দেখলে সে দূর্গে আঘাত হেনেছে যারা তারা এর বিপরীতে কি গড়ে তুলতে চাইছে? কোন সমাজ গড়ে তুলতে চাই তারা?

যারা আগুন ধরিয়েছে তারা যে অবুঝের মতো নিজেদের শরীরেই আত্মায় আগুন ধরালো এটাও তাদের জানতে দিতে হবে সে জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা রাষ্ট্র এবং সমাজ উভয়ের মিলেমিশে করতে হবে।
এ আগুন কোথায় লেগেছে? শাহ আব্দুল করিমের শিষ্যের গানের ঘর, বইপত্র,বাদ্যযন্ত্র আগুনে পুড়ে গেল নাকি বাংলাদেশের যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানবিক বোধের ঘর পুড়ল? ভেবে দেখার সময় আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামীর কোন বাংলাদেশ দেখতে চাইছি আমরা।

১৯.০৫.২০২০

নতুন যুগে পৃথিবী - এম. ইকবাল

পৃথিবী খুব সম্ভবত নুতন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। 


    এই সময়ে পৃথিবীতে হতে পারতো তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধ, যেটা অনেকদিন ধরেই অনেক বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, যদিও বিশ্বজুড়ে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এছাড়াও ইরান-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া, ভারত-(কাস্মীর)পাকিস্থান, হিন্দু- মুসলিম, (ভারত- NRC, CAA), রোহিঙ্গা নিধন(মিয়ানমার), নির্বাচন ও নেতৃত্বের পালাবদল এবং আরও অসংখ্য রাজনৈতিক ইস্যুকে ঘিরে সারা পৃথিবীজুড়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাধারন মানুষ থেকে রাষ্ট্রীয় কর্নধার পর্যন্ত সবার মাঝেই এক ভয়াবহ অস্থিরতা কাজ করছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধ হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতো নিঃসন্দেহে। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন অনিবার্য ফল হিসেবে পরবর্তী প্রজন্ম পরম্পরাগতভাবে প্রাপ্ত শত্রুতা লালন করে বেড়ে উঠত। ফলে পরবর্তী আরেকটা যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকেই যেত।

    এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস সেই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। মানুষে মানুষে শত্রুতার বদলে পৃথিবীর মানুষের সামনে নুতন চ্যালেন্জ ছুড়ে দিয়েছে। এতে মানুষ তার অসহায়তা এবং ক্ষমতার সীমাটাকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। সেই সাথে যতো সময় যাবে এই উপলব্ধিটা ততোই স্পষ্ট হবে।
এটা আমার কথা নয়। বিগত পৃথিবীর ইতিহাস এটাই বলে। যতক্ষণ মানুষের সামনে মানুষ ব্যতীত অন্য কোন বিপদজনক শত্রু অনুপস্থিত ছিলো ততক্ষণ মানুষের মাঝেই বিভেদ ছিলো, মানুষই মানুষের শত্রু ছিলো। যখনই মানুষের সামনে তৃতীয় কোন বিপদজনক শত্রু এসে উপস্থিত হয়েছে তখনই মানুষের মাঝে বিভেদের পরিবর্তে ঐক্যতা এসেছে।

তাহলে কি মানুষে মানুষে ঐক্যতার প্রশ্নে তৃতীয় কোন শত্রু অনিবার্য?

সম্ভবত, না- অনিবার্য না। ওটা বিগত পৃথিবীর ইতিহাস। এখানেই পৃথিবীতে বড় একটা পার্থক্য ঘটে যাচ্ছে। আগামী পৃথিবীতে মানুষে মানুষে ঐক্যতার কারন হিসেবে তৃতীয় কোন শত্রুর প্রয়োজন পড়বে না। মানুষের নির্বুদ্ধিতার দিন শেষ হয়ে বোধের উন্মেষ ঘটতে যাচ্ছে। এখানেই মানুষ নতুন যুগের শুরু করতে যাচ্ছে।

কোভিড ঊনিশঃ মানবীয় মর্যাদা ও নতুন সংবিধান - ভূবন মুন্সী



করোনা সংকটে সাবান পানি আর কোয়ারান্টাইন কার্যকরী ভূমিকা রাখে। গোটা বিশ্বের সাথে আমরাও সংকট উৎরে যাবার জন্য একই পন্থা অবলম্বন করছি।

তবে কোয়ারান্টাইন না মানা ( যাপনের প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষ, বিশেষত পিতৃ বয়সী মানুষ, যাপনের প্রয়োজন মিটলে যাদের বাসায় অবসরে থাকার কথা) মানুষ গুলোকে শাস্তি প্রদানের ধরন দেখে দেশবাসীর ক্ষুব্ধতা প্রকাশ, যা মূলত সংকট কিংবা যে কোন পরিস্থিতিতে মানবীয় মর্যাদার পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত হতে না দেওয়ার বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ যাপনে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানবীয় মর্যাদাকে নিশ্চিত করা আবশ্যক। আর প্রথম শ্রেণির ক্যাডার দ্বারা এমন কার্য করা, কোন ব্যক্তি মানুষ নয় এটা আমাদের সামাজিক-রাষ্ট্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার নৈতিক গলদ টুকু প্রকাশ করে। এটা লজ্জার এবং এ লজ্জা ব্যক্তি রাষ্ট্র সবার, বিশেষত স্বাধীন দেশে আইন- প্রশাসন ও শিক্ষানীতি প্রণয়নের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিগণ ভয়ংকর লজ্জায় নিজেদের শোধরে নিক।...

বস্তুত এ সংকট বিশ্ববাসীকে নতুন করে ভাবতে শেখালো। সংকট বৈশ্বিক, বৈশ্বিক ভাবে একে নির্মূল করতে পারলেই আমরা সেফ।....

এ সংকট কতদিন টানতে হবে জানা নেই... তবে আর এক দুই পক্ষ কালের মধ্যেই রাষ্ট্র নায়কদের যোগাযোগটা বৃদ্ধি পাবে। ভিডিও বৈঠক উঠে আসবে মিডিয়ার পর্দায়, খবরের কাগজে। সার্ক, ওআইসি, জি-৮, জি-৭৭, ইউনিয়ন সমুহ সমস্যা সুরাহার প্রশ্নে পারস্পরিক মত বিনিময় করবে। অর্থনৈতিক কারণেই কিছুটা খিস্তিখেউড় পরিবেশ তৈরি হবে, দোষা-দোষী চলবে, দলাদলি হবে। লালন গাইবে- এসব দেখি কানার হাঁট বাজার!

করোনা সংকট সমাধানে সাবান সচেতনতা ও সঙ্গরোধ কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও, অর্থনৈতিক সংকটটা সাবান/সোডা সচেতনতা দিয়ে সম্ভব নয়।

...সংকট সমাধানে বৈশ্বিক পরিকল্পনা অনিবার্য, বিশেষত সংকট পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে। এটা রাষ্ট্র সমুহের পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতার উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে রাষ্ট্র সমুহের পারস্পরিক শর্তগত সম্পর্কের উপর- যা বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামোকে অনিবার্য করে তুলে।

বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামোর প্রশ্নে বৈশ্বিক সংবিধানটা জরুরী, আর এ জন্য মার্ক্স পরবর্তী দর্শনগত বন্ধ্যাত্বেদীর্ণ পৃথিবীতে নয়া দর্শনের আবির্ভাব আবশ্যক।
তাই নয় কি বন্ধু?


২৮.০৩.২০২০

ইতিহাসের বৃহত্তম ধোঁকা - ভূবন মুন্সী


এই মুহূর্তে পৃথিবী এক আশ্চর্য আতঙ্কের ভিতর দিন যাপন করছে। করোনা ভাইরাস তার জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে পৃথিবীতে। এটা সাইক্লোন কিংবা টর্নেডোর মতোন ঘর বাড়ি উপড়ানো তান্ডব লীলা নয়, জৈবিক হাত দ্বারা নির্মিত পারমানবিক বোমার বিধ্বংসী আগ্রাসনও নয়, এটা যেন অনেকটা গলা টিপে ধরে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ক্রমাগত হত্যার আয়োজন।

সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার মোড়ল রাষ্ট্র গুলো এখনো ব্যর্থ চোখ মেলে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে। আগ্রাসী অসহায়ত্ব পরস্পরকে ক্রমশ আলাদা করে দিচ্ছে। সার্বিয়া এই দূর্দিনে বুঝে গেলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন "রূপকথা" বৈ আর কিছু নয়। সার্ক, ওআইসি, জি-৮ সহ আঞ্চলিক জোট গুলো জোটহীনতার চেহারায় উপস্থিত। বৈশ্বিক জোটের বাতিঘর জাতিসংঘ মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

সকলে একসাথে কি মিথ্যে প্রবঞ্চনাই না করেছে বেড়ে উঠা প্রজন্মের সাথে। চন্দ্র, মঙ্গল অভিযান নিয়ে ব্যাস্ততা  দেখিয়েছে এতোদিন, কি বৃহৎ আস্ফালন! অথচ সব অভিযান  আজ ম্লান হয়ে গেলো করোনার সংকটে।


তারা এতোদিন স্পাইডার ম্যান এর অলৌকিক শক্তিকে দেখিয়েছে মানুষের পক্ষে, পক্ষান্তরে ভিন গ্রহ থেকে আসা এলিয়েনদের শায়েস্তা করেছে। সবার কি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এলিয়েনদের ধরতে, মারতে! অথচ কিনা পৃথিবী নামক গ্রহটাকে রেখেছে পুরো অরক্ষিত। রাষ্ট্র আর "অদৃশ্য মোড়লেরা" নিজেদের পুঁজির বিকাশে পৃথিবীকে ক্রমাগত ঠেলে দিয়েছে সংকটের খাঁদে।

এক ধরনের সিন্যামাটিক তথ্য প্রযুক্তি প্রদর্শন করে অলৌকিক মগজ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মকে। একদিকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংহত করেছে নিজেদের পুঁজিবাদী অস্তিত্ব, অন্যদিকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মানুষের দৃষ্টি নিয়ে গেছে বাস্তবতা বিবর্জিত অলৌকিকতার দিকে।

অদৃশ্য মোড়লেরা বিজ্ঞানকে হস্তগত করেই ব্যাপক হারে ঘটিয়েছে ইন্ড্রাস্টিয়ালাইজেশন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং ত্বরান্বিত করে বাড়িয়ে দিয়েছে সি-লেভেল। বরফ গলে অবমুক্ত হয়েছে প্রাচীন জীবানু। বাড়িয়ে দিয়েছে খরা, বন্যা, জ্বলোচ্ছাস, অগ্নুৎপাত আর ঘন ঘন মহামারীর হুমকি।

সার্স সংকট পরবর্তী পৃথিবীতে নতুন মহামারীর আশংকা থাকা সত্ত্বেও মোড়ল রাষ্ট্র ও অদৃশ্য মুরুব্বীদের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংকটের প্রাক মুহুর্তে ট্রাম্পের উক্তি (রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের দিকে ঠেলে দেওয়ার কৌশল, কোভিড-১৯) রাষ্ট্রের গদিতে বসে থাকা পুরোহিতদের ভাবনার কেন্দ্রকে চিহ্নিত করে। গদিটাই আসল, বাদবাকি চিচিং ফাঁক।

'মার্চের ১৬ তারিখ, ঠিক যেদিন স্পেনিশ সরকার সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ; সেইদিনই মাদ্রিদের একটি হাসপাতালের বাইরে অঝরো ক্রন্দনরত এক নারীর ভিডিও ফুটেজ দেখেছিল গোটা বিশ্ব। তার স্বামী সবেমাত্র করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং পরীক্ষায় তারও করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছিল। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা করার মতো ‘যথেষ্ট অসুস্থ নয়’ বলে এই নারীটিকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল'। যথেষ্ট অসুস্থ নয়, সেলুকাস!

নভেম্বরে নতুন রোগের সন্দেহ উদ্রেক হলেও উহানে লক ডাউন উদ্যোগ নেওয়া হয় জানুয়ারীর তেইশ তারিখে। বিলম্বের কারণতো স্পষ্ট- প্রবৃদ্ধির সূচক নিম্নগামী হওয়ার ভয়। সেলুকাস!

তবে যোগ্যরাই টিকে থাকবে- এ নীতি সচল হলে রাষ্ট্রিক ঠকুর, পুঁজিপতি পান্ডব আর একনিষ্ঠ প্রজাগণ ছাড়া বাকিরা যে কোভিডে ধরা খাবে অথবা দূর্ভিক্ষে এটা নিশ্চিত।

এলিয়েন মারার স্বপ্ন দেখে বেড়ে ওঠা তরুন, বিপদ দেখে মনে মনে স্পাইডার ম্যান হয়ে ওঠা তরুন কি সাংঘাতিক ধোঁকা পেয়ে এসেছে পূর্বজদের কাছ থেকে। অন্তত শিকরী যুগের আদিম মানুষগণও এতো কপটতা করার নির্মমতা দেখায়নি।

করোনা ভাইরাস কিংবা তার সাথে আগত সংকট সমাধানের নূন্যতম যোগ্যতা পৃথিবীর নেই, ভাবতেই অবাক লাগে। অথচ চন্দ্র, মঙ্গল অভিযানে, সমরাস্ত্রে কি বিশাল ইনভেস্টমেন্ট। স্পাইডার ম্যান, এলিয়েন নিয়ে কত মাতামাতি, শিশুদের পুষ্টির যত্নে ডানো, হরলিক্স, মাদার হরলিক্সের বিজ্ঞাপনী প্রচার। কি ফাঁপা শক্তিমত্তা, মেকি যত্নআত্তির প্রকাশ। সেলুকাস!


০৩.০৪.২০২০

পুনরাবৃত্তি - ১ > এম. ইকবাল



লোকটার ডাকনাম হাবু, পেশায় কৃষক, পড়াশোনার দৌড় কেলাস ফাইভ পর্যন্ত। বাপের সামান্য জমি আছিল, চাষবাষ কইরা কোনমতে দিন চইলা যাইতো। পড়ালেহার খরচ জোগাবার না পাইরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইয়া গেছিলো হাবুর। একটুখানি জমি, কোনমতে দিন চলে, এইডা বেইচা তো আর পড়ালেহা করানো সম্ভব না, তাছাড়া পড়ালেহা কইরা কি হইবো? গরীব মানুষ, চাকরি দিব কেডায়? দেশে যে গন্ডগোল চলতাছে কখন যে কি হয় কওয়া যায় না।

হাবুর বাপ বাবলু, যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর হাত থেইকা কোনমতে জান নিয়া পালাইতে গিয়া অন্ধকারে গর্তের মধ্যে লাফ দেয়। নিচে শক্ত মাটি আছিল, বুঝবার পারে নাই। মাটিতে পইড়া ডাইন ঠ্যাং ভাইঙ্গা গেছিল। চিৎকার মারবারও পারে নাই, পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়বার ভয়ে। দুইদিন গর্তের মধ্যে লুকাইয়া আছিলো। ‍দুই দিন পরে রাইতের বেলা অন্ধকারে গর্ত থেইকা বার হইয়া কোনমতে ঘরে ঢুইকা দেখে ঘরের সব কিছু লন্ডভন্ড, খাবার মত কিচ্ছু নাই ঘরে। যা আছিল সব ঐ কানা মন্টু নিয়া গেছে। বাবলুরে আর মুক্তিবাহিনীর পোলাপানরে ঘরে না পাইয়া ঘরের সবকিছু লন্ডভন্ড করে। তারপর তার বাড়ির আশেপাশে সব জায়গায় খুজে। তবুও তারে খুইজা না পাইয়া তার পাকা ধানক্ষেতটারে পাড়ায়া মাটিতে মিশায়া ফেলে।
বাবলুর গলা শুকায়া আসে, বাড়ির পাশের পাগাড় থাইকা ভাঙ্গা গেলাসে একটু জল নিয়া খায়, গলাডা ভিজায়। ভিজা গলায় চিৎকার দেওন যায়, শব্দ বেশি হয়। কিন্তু গলাডা আবার শুকাইয়া যায়। সে আর চিৎকার দেয় না। ধানক্ষেতটার দিকে তাকাইয়া সে শুকনা গলায় বিড় বিড় করে- “হালারা আমার ধানক্ষেতটারে শেষ কইরা দিলো”।

অন্ধকারে কাউরে খুইজা না পাইয়া দুইদিনের খালিপেট নিয়া সে ঘরের মেঝেতে শুইয়া পড়ে, প্রচন্ড বেদনা আর ভাঙ্গা ঠ্যাং নিয়াই কোনমতে ঘুমায়।
পরের দিন পাশের বাড়ির কানু মিয়া বাবলুর বাড়িতে খোজ নিতে আইসা দেখে লোকটা ঘরের মেঝেতে মরার মতন পইড়া আছে, ডাইন পাও ভাঙ্গা। সে তাড়াতাড়ি বাবলুরে ধইরা নিয়া চাইরডা খাওয়াইয়া তার নিজের রিকশা দিয়া বাবলুরে শশুর বাড়ি পৌছাইয়া দেয়।

বাবলু মুক্তিবাহিনীর লাইগা নিজের ঘরে ডাইলভাত খাওনদাওনের ব্যবস্থা করতো। পাশের এলাকার কানা মন্টু জাইঙ্গার ব্যবসা ছাইড়া দিয়া রাজাকার বাহিনীতে নাম দেয়। তার কাম হইলো পাকবাহিনীরে নানান খবর সরবরাহ করা। তয় পাশের এলাকায় বাবলু যে এত বড় একটা কাম করতাছে, গোপনে মুক্তিবাহিনীরে ঘরে থাকবার ব্যবস্থা কইরা দিছে, খাওনাদাওনের ব্যবস্থা কইরা দিছে, এত বড় একটা খবর পাকবাহিনীরে না দিয়া সে কেমনে থাকে? তার একটা দায়িত্ব আছে না?

মুক্তিবাহিনীরা কয়দিন পরে পরে মাঝে মধ্যেই রাইতের অন্ধকারে গোপনে বাবলুর বাড়িতে আইসা উঠে। যুদ্ধ করতে করতে গুলি আর বোমা ফুরাইয়া গেলে দুই একদিনের জন্যে বাবলুর বাড়িতে আইসা উঠে। এই এলাকায় বাবলুই তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। তারপর দুই-তিন দিন ভালমন্দ খাইয়া, গুলি আর বোমা হাতে পাইলে আবার হঠাৎ কইরা রাইতের অন্ধকারে উধাও হইয়া যায়। দুরের কোনো এলাকায় অপারেশন চালাইতে চইলা যায়।
সেইদিনও মুক্তি বাহিনী খবর পাডায় বাবলুর কাছে, আইজকা তারা বাবলুর গেরামে আইবো, একদিন থাইকা চইলা যাইবো। কোনমতে খাওনদাওনের ব্যবস্থ্যা করলেই হইবো, এত ভালো কিছু রান্ধন লাগবো না। তাছাড়া বাবলুর বউডা পাঁচ মাসের পোয়াতি, বেশি রান্ধিবার গেলে তার বউয়ের কষ্ট হইয়া যাইবো।

বাবলুর আরেকটা পোলা আছিল, বছরখানিক আগে উডানে খেলতে গিয়া পানিতে পইড়া ডুইবা মরে। দেড় বছরের পোলা, সারা বাড়ি দৌড়ায়া বেড়াইতো, বাপ-রে কেবল চিনছে কোনমতো। একদিন বাবলুর বউ শেফালী রান্ধিবার গেছে, পোলাডা বল নিয়া উডানে খেলতেছিল। শেফালী একটু পরে পরে ঘর থাইকা উকি দিয়া পোলাডারে দেখে, বাইরে খেলতাছে কি না। আছরের আযান দেওয়ার লগে লগে শেফালী মুখ বাইর কইরা পোলাডারে খোজে, দেখে পোলাডা উডানে নাই। শেফালীর বুকের মধ্যে ছ্যাৎ কইরা উডে। দৌড় দিয়া উডানের আরেক মাথায় যায়। দেখে পোলাডা আবার ধান ক্ষেতের দিকে গেল কি না! পোলাডারে দেখা যায় না। শেফালী চিৎকার কইরা ডাকতে থাহে, হাবুরে, হাবু, কই গেলি রে বাপ, ও হাবু, হাবুরে… কোন সাড়া শব্দ পায় না শেফালী। শেফালীর মাথা ঝিম ঝিম কইরা উডে, সে কানে যেন কিছু শোনে। পানিতে ঢিল মারলে যে শব্দ হয়, সেই শব্দ। দৌড় দিয়া পাগাড়ে যায়।

পাগাড়ের মাঝখানে লাল বলডা দুলতে দুলতে ভাসতাছে। আর কি যেন একটা পানির নিচ থেইকা বুদবুদ ছাড়তাছে। শেফালীর বুকটা ধড়ফড় কইরা উঠে। চিৎকার দিবার চায় কিন্তু গলা দিয়া কোন শব্দ বের হয় না। সে দৌড় দিয়া পাগাড়ের মধ্যে চইলা যায় যেহান থেইকা বুদবুদ উঠতেছিল। দুই হাতে পোলাডারে ধইরা কাছাড়ে তুইলা গলা ফাডায়া চিৎকার করে- আল্লারে--- আমার কি হইলো রে--- আমার হাবুরে--- । হাবু তহনও মরে নাই একটু একটু কইরা হেচকি মারতাছে। কিন্তু শেফালী কি করবো বুঝতে পারে না। পোলাডারে বুকের মধ্যে একবার চাইপা ধরে আর একবার নামায়া পেডের মধ্যে চাপ দেয় যদি পেট থেইকা পানি বাইর হয়। আশেপাশের মানুষজন দৌড়ায়া আসার আগেই হাবুর শরীর নেতায়া আসে। পোলাডা আর দম নিবার পারে না। মায়ের চউক্ষের সামনে পোলাডার দুইচোখ বন্ধ হইয়া যায়। শেফালীও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়া মাটিত পইড়া মুর্ছা যায়।

দুই তিনডা মাস শেফালী আর বাবলু কেউ কারো দিকে তাকায় না। দুই জনের মুখ শুকায়া কাঠ হইয়া যায়। খাওয়ার কোন ঠিক নাই, ঘরদোড় সব আওলাঝাওলা কইরা দুই জন ঘরের মধ্যে পইড়া থাহে। এই দুর্দিনেও পাশের বাড়ির কানু মিয়ার বউ তাদের রান্ধা বাড়া কইরা খাওয়ায়। এই এলাকায় বাবলুর  কাছের মানুষ বলতে ওই একটা পরিবারই আছে। কানু আর কানুর বউ চাম্পা। তাদের কোন পোলাপান নাই। হাবুর পোলাডারেই তারা নিজের পোলার মতো আদর করতো। হাবু মইরা যাওয়াতে দুইডা পরিবারই ভাইঙ্গা পড়ে। কানু পেশায় রিকশা চালক। সে নিজের রিকশা চালায়, বড়লোকী কারবার ।

কয়েক দিন ঘরে পইড়া থাইকা বাবলু ঘর থেইকা বাইর হয়, ক্ষেতে যায়। ধানক্ষেতটা মনোযোগ দিয়া দেখে। এই ধানক্ষেতটাও তার পোলার মতোই। ধানক্ষেতটার দিকে তাকায়া আবার তার পোলার কথা মনে হয়। সে গামছা দিয়া মুখ ঢাইকা কতক্ষণ কান্দে। তারপর আস্তে আস্তে উইঠা কিছুক্ষণ ধানগাছ গুলারে হাতায়। তারপর মনডারে শক্ত কইরা নিজেরে কয়, যা হইবার হইছে, আল্লার ফেরেসতারে আল্লায় লইয়া গেছে, আমার আর বইসা থাকলে চলবে না, এইবার কামে নামতে হইবো। সে দিল থেইকা পোলাডার লাইগা আল্লার কাছে দোয়া করে- হে আল্লা, তুমি আমার পোলাডারে জান্নাতে জায়গা দিও।

দেখতে দেখতে প্রায় বছর যায়। বাবলুর বউ আগের সবকিছু ভুইলা একটু স্বাভাবিক হয়। তার পেটে আবার বাচ্চা  আসে। দুইজনের মুখেই আবার কিছুটা হাসি ফুইটা উঠে। এর মধ্যেই শুরু হয় গন্ডগোল। পাকবাহিনীরা হঠাৎ কইরা রাইতের আন্ধারে ঢাকা শহরে আক্রমণ কইরা বসে, বাড়ি ঘরে আগুন লাগায়। তারপর থেইকা শুরু হয় যুদ্ধ। সারাদেশেই মুক্তিবাহিনীর দল তৈরী হয়। জায়গায় জায়গায় মুক্তি বাহিনীরা অস্ত্র নিয়া পাহারা দেয়। সেই সাথে রাজাকারেরাও সারা দেশে তাদের কার্যক্রম চালায়, পাকবাহিনীরে সাহায্য করাই তাদের কাম। পাশের এলাকার মন্টু সেই সময়ই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। মাইনষের বাড়িঘরে আগুন লাগায়া জিনিসপত্রগুলা যদি লোপাট করন যায় সেই আশায়। তাছাড়া এই যুদ্ধের সময়তো তার জাইঙ্গার ব্যবসা চলবে না। তাইলে সে খাবে কি?

ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয়। বাংলাদেশের জন্ম হয়। সব মানুষের মুখে হাসি। পেটে ভাত নাই, তবুও শান্তি। হারামজাদারা দেশ থেইকা বিদায় হইছে। কিছুদিন পড়েই মন্টুর ঘরেও আলো ফুটে। আরেকটা পোলার জন্ম হয়। কি সুন্দর পোলাডা! ঠিক যেন হাবু। জন্মের পরেই পোলাডার চিৎকার শুইনা শেফালী চমকাইয়া উঠে। এই চিৎকার তো সে আগেও শুনছে! বড় পোলা জন্মের সময়ই ঠিক এই চিৎকারটাই দিছে। ঠিক একই চেহারা, একই গলা। শেফালী সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক কইরা ফেলে, এই পোলার নামও সে ‘হাবু’ই রাখবে। এই পোলার মধ্যে দিয়া সে আগের পোলাডারেও খুইজা পাইছে। শেফালীর মনে হয়, তার চাইতে সুখী দুনিয়াতে আর কেউ নাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার তার মনে হয়, দেশে এহন আকাল, ঘরে ক্চ্ছিু নাই, পোলাডারে ঠিকমতো খাওয়াইতে পারবো তো? তবুও পোলাডার মুখের দিকে চাইয়া দিলডা জুড়াইয়া যায়। ঘরে খাওন নাই, তাও শান্তি।

কষ্টে কষ্টে তবুও দিনগুলা চইলা যায়। পোলাডা আস্তে আস্তে বড় হয়। যে বছর পোলাডার স্কুলে যাওয়ার কথা, তার আগের বছর দেশে আবার গন্ডগোল হয়। বঙ্গবন্ধুরে গুলি কইরা মাইরা ফেলে কত্তগলা বেইমান। পুরা দেশ থমথমে হইয়া যায়। সেনা বাহিনী দেশের ক্ষমতায় যায়। তারপর থেইকা দুই-তিন বছর পরে পরে একটার পর একটা গন্ডগোল লাইগা আছে। এর মধ্যে দিয়াই পোলাডা ক্লাস ফাইভ পাস করে। পড়ালেহা করানোর ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারনে হাবুরে আর স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হয় নাই। বই খাতা ছাইড়া দিয়া বাপের সঙ্গে মাঠে কাম করতে যায়। শেফালীর বুকটা ধুকপুকাইয়া উঠে। পোলাডারে লেহাপড়া করানোর ইচ্ছা আছিল, একটুখানি জমি, আবাদ-ফসল কইরা কোনমতে সংসার চলে, এইডা বেইচা তো আর পড়ালেহা করানো সম্ভব না। তাছাড়া পড়ালেহা করায়া কি হইবো ? গরীব মানুষ! চাকরি দিব কেডায়?
এমনিতেও দেশের যা অবস্থা, কহন কি হয় তা তো কওয়া যায় না। হাবুর আর পড়ালেহা করা হয় না। গামছা কান্দে লইয়া, লেংটি পইড়া বাপের লগে মাঠে কাম করতে যায়। ধীরে ধীরে ওই একটুকরা জমিই তার দেশ, দুনিয়া হইয়া ওঠে। ওখানেই ধান চাষ করে, ওখানেই সবজি চাষ করে। মাঝে মধ্যে মাইনষের ক্ষেতেও মজুরীর কাম করে। আস্তে আস্তে সংসারের সব কাজ কাম শিইখা ফেলে। স্বৈরাচার সরকারের পতন হইলে দেশে গণতন্ত্রের শুরু হয়। তার সংসারেও গণতন্ত্রের ছোয়া লাগে। তারে বিবাহ দিয়া বাপ মা কিছুটা দায়মুক্ত হয়। এদিকে গনতন্ত্র কিছুদিনের মধ্যেই একনায়কতন্ত্রে পরিনত হইলো। সে বুঝতে পারে, সংসারে সে মূল্যহীন। অভাবের সংসারে সব পুরুষরাই কাপুরুষ। তবুও যে-সব মহিলারা অভাবের সংসার ধইরা রাখতে প্রাণপন চেষ্টা কইরা থাকে তারা নিতান্তই সাদাসিধা বোকা টাইপের মহিলা। কিন্তু হাবুর বউ কোন মতেই বোকা মহিলা ছিলেন না। তাই সে একটা বাচ্চার জন্ম দিয়া তাকে হাবুর কোলে তুইলা দিয়া ঘর ছাইড়া বাহির পানে চইলা গেলেন এই ভেবে যে- যদি অভাবটাকে অতিক্রম করন যায়। পরে তার কি হইছিল তা কেউ জানে না, কারন যে নারী ঘর ছাইড়া যায়- তার খবর কেউ কইতে পারে না অথবা রাখে না। এইদিকে হাবু নীরবে তার বউয়ের বিদায়শোক অতিক্রম কইরা চান্দের কনা পোলাডারে কোলেপিডে কইরা মানুষ করতে থাকে। এইদিকে হাবুর বাপ-মা, অর্থাৎ বাবলু আর শেফালী পোলার কষ্ট আর একাকীত্ব বুঝতে পাইরাও সব নিয়তি মাইনা লইয়া ফুটফুটে নাতির লগে আনন্দ ভাগাভাগি করার অভিনয় করতে করতে কিছুদিনের মধ্যে দুইজনই ইহকাল ত্যাগ করলেন। হাবুও কিছুদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করতে পারল যে, পোলাডারে পাইয়া সে হাতে চাঁদ পাইয়াছিল বটে কিন্তু বাবা-মা কে হারাইয়া চিরকালের জন্য সে যেন সূর্যটারে হারাইল।

[হাবুর জীবনের পরবর্তী গল্পটা খুবই করুণ। কারন, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে দিয়া দেশটা এমন একটা জায়গায় পৌছে যাচ্ছিল যেখানে হাবুরা সমাজের পতিত, ফেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া ছোট খাটো কৃষক হিসেবে পরবর্তী বাংলাদেশে তাদের কোন জায়গা ছিলো না। বেশিরভাগ কৃষকরা তাদের কৃষিজমি সহ কৃষকত্ব হারাইতে হারাইতে প্রথমে শ্রমিক এবং পরে সমাজের উচ্ছিষ্টভোগী, ত্রানভোগী হয়ে বাঁচতে থাকে। এক্ষেত্রে হাবু প্রাণপনে পিতৃভুমিটুকু আকড়াইয়া ধরিয়াছিলো। পিতার রেখে যাওয়া জমিটুকুতে সে প্রতিবছর ফসল ফলায়।]

কিন্তু তারও এহন বয়স হইছে। যদিও সে এহন এই যুগের মানুষ তবুও এই যুগের কোন প্রভাব তার উপর পড়ে নাই। এই করোনা ভাইরাসের আমলেও সে তার ক্ষেতডারে সবুজে সবুজে ভইরা ফালাইছে। কিন্তু সে জানতো না তার ছোডো ধানক্ষেতটাও প্রযুক্তির কারনে ইতিহাসের পাতায় জায়গা কইরা নিছে। তার ক্ষেতে কি কারনে এত সরকারী-বেসরকারী নেতা, সাংবাদিক, পুলিশ, বিজিবি, এমপি, মন্ত্রীদের ভিড় তা বুঝবার পারে না। তার আগেই সে বুইঝা যায়, এইবার তার না খাইয়া থাকতে হইবে আর না হয় মাইনষের দুয়ারে হাত পাততে হইবে। সে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বইসা পড়ে। মাটির সাথে মিশ্যা যাওয়া পাকা ধানের ছড়াগুলার দিক তাকাইয়া মনের খেয়ালেই সে বইলা উঠে “হালারা আমার ধানক্ষেতটারে শেষ কইরা দিলো”।

Saturday, May 16, 2020

কোন পথে পৃথিবী? ভূবন মুন্সী



এ এক বাইবেলিক সংকট! পথ জানা নাই। ৭.৮ বিলিয়ন মানুষ পথহীনতায় ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিচ্ছেন। দার্শনিকগণ সম্ভাব্য পথ ও পরিণতি বাতলে দিচ্ছেন। রাষ্ট্র নেতারাও আশা নিরাশার দোলাচালে জনগনকে আশ্বস্থ করছেন। ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল- সবার উৎসুক চোখ এখন COVID- 19 এ। অন্তত বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গন, ১ম ও ২য় বিশ্ব যুদ্ধ- এসবে মানুষের চোখ আজকের মতো ব্যাপক ব্যাপ্তিতে উৎসুক ছিলোনা। টুইন টাওয়ার হামলা, আফগানিস্তান - ইরাক -  লিবিয়া হামলা কিংবা লাদেন - সাদ্দাম - গাদ্দাফি সবটা মিলিয়েও মানুষের চোখে এতোটা উৎকন্ঠা জেগে ওঠেনি। এটা প্রভাব ও প্রায়োগিকতায় এবং মাত্রা ও গভীরতায় একদম ভিন্ন, নতুন- রিখটার স্কেলে এর কম্পন মাত্রা দশোর্ধ্ব; সুনামির চেয়েও প্রবল ঝাঁকুনি দিচ্ছে।


এটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সবলতা- দূর্বলতা সমুহ ওপেন করে দিচ্ছে এবং সমাজ মননের গভীরতর আকুতিকে আরো অধিক স্পষ্টতায় নিরীক্ষণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

আমরা জানি, প্রত্যেক সংকটই বেশ কিছু স্থায়ী এবং অস্থায়ী পরিবর্তন সাধন করে। তড়িঘড়ি করে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়- অনেকটা জরুরী অবস্থা জারী করে কেন্দ্র কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের মতো। জনগনও মেনে নেয় - তাদের মনোযোগ সন্নিবিষ্ট থাকে মহামরীতে বা এ সিদ্ধান্ত হয়তো সংকট উৎরে দেবে- এ আশ্বাসে। এমন পরিস্থিতি রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারী স্বভাবকে আরো সংহত করে।

সংকটকালীন সময়ে (crisis moment) গৃহীত সিদ্ধান্তসমুহ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক অবস্থায় তা গনবিরোধী, স্বৈরাচারী, শোষণমূলক সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। রাষ্ট্রও সেখান থেকে বেরিয়ে না এসে বরং সে সিদ্ধান্তকেই সর্বদার জন্য যুক্তিযুক্ত গণ্য করে সচল রাখতে থাকে। অন্তত আমরা এটুকু জানি, আপদকালীন সিদ্ধান্ত সমূহ গ্যাটিসমারা সল্যুশন হয়ে থাকে কিংবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাকারণিক সমাধান (grammatical solution) এড়িয়ে যাওয়া হয়।

ব্যাকারণিক সমাধান- এটা বিদ্যমান সংকটের উৎসমূল খোঁজে বের করে। রাষ্ট্রিক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট সমূহের মূলোৎপাটন করতে সচেষ্ট থাকে। শুধু আজকের করোনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলমান জলবায়ু সমস্যা কিংবা আর্থিক মন্দা অথবা সামজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান নৈতিক ধ্বস, অবক্ষয়, অস্থিরতা - যা মানুষকে আরও অধিক বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বা জীবনের প্রতি বিপন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি জাগিয়ে তুলে মানুষকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করছে - এসব সমস্যা কোন ভাবেই ব্যাকারণিক বা দর্শনগত দিশা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।  এ দিশা যেমন দেশজ, সেই সাথে বৈশ্বকতাকে ধারণ করে হতে হবে। কোন মানুষ কিংবা কোন রাষ্ট্রই আজ আর বিচ্ছিন্ন নয় এবং তাদের সমস্যাগুলোও। প্রযুক্তির উল্লম্ফনে বিশ্ব এখন গাঁয়ের চেয়েও ছোট।

মহামারীর এ কালে আমরা রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্পনে চোখ রাখতে পারি।

রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে দেখবো- দায় দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের যোজন বিয়োজন শেষে রাষ্ট্র সমুহের কপালে ব্যার্থ রাষ্ট্রের কালো টিপ সেঁটে দেওয়া যায়। খুব জোরেশোরে এবং বারবার উপদেশই সম্বল হয়ে উঠছে। ঘরে থাকা বা নিরাপদ থাকার ব্যাপারে রাষ্ট্র ব্যাক্তিকেই প্রধান গন্য করছে এবং মহামারী কালে রাষ্ট্র এটাই করে।

স্বাভাবিক অবস্থায়, উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়, ট্যাক্স বৃদ্ধিকে জন-কল্যাণ বলে প্রচার করা হয়, রাষ্ট্রের সফলতার ব্যানার মোড়ে মোড়ে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক বিপরীতে সংকট কালে ব্যাক্তির পারফরম্যান্সকে মূখ্য বলে প্রচার করা হয়। অর্থাৎ স্ব-উদ্যোগে সংকট মোকাবিলা করুন, ঘরে থাকুন- সুস্থ থাকুন কিংবা ধান বন্যাকবলিত হলে শোনা যায়- বেশি করে আলু খান অথবা ধান, আলু উভয়ই নষ্ট হলে শুনবো- রাষ্ট্রের জন্য রোজা রাখুন ইত্যাদি।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমুহের ব্যার্থতা হিমালয় বা আল্পসের চেয়ে ভারী। ওপেন-ক্লোজ কিংবা রান-স্টপ ডিসিশনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেন আবাল বালক - মতিভ্রম মাথার মতোন হুটহাট ডিসিশন, হুটহাট হুংকার কিংবা হুট করেই সিদ্ধান্ত বাতিল। এটা বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা হয়ে সবখানে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বা অবহেলার অস্ত্রে খুন কমন ম্যাটারে পরিণত হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট, ম্যান্টালি সিক অর্থনৈতিক সিস্টেম বলবৎ রয়েছে। অ্যানি হাউ মুনাফা বৃদ্ধিই অর্থনীতির প্রধান কাজ। অর্থাৎ খাবারের জন্য নয়, কেকটা আরও বড় করার জন্যই কেক বানানো হয়েছে। অতীতের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ, অথচ দুর্ভিক্ষ, অনাহার কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা।

আজাইরা কাজ নিয়েও অর্থনীতিটা বেশ ব্যাস্ত। পয়সা কামানোই হক কথা; ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই- পর্নোগ্রাফি হলেও আপত্তি নেই। দ্রুত মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সাপ্লায়ের ইচ্ছা, লকডাউন, কোয়ারিন্টিন এর ইন্টেনশনও জন কল্যাণ নয়, বরং ক্ষমতা এবং অর্থ। অন্তত ট্রাম্প এবং তার সচিবের কথা থেকে তা স্পষ্ট।  সচিবতো বৃদ্ধ মানুষকে মূল্যই দিচ্ছেন না বরং ভাবছেন দু-চারজন বৃদ্ধ মরেও যদি অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকানো যায় সেটাই ভলো। অর্থাৎ লকডাউন তুলে নিতে চাই।

সামাজিক ক্ষেত্রে, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাও অধিক খোলাসা হয়েছে। বিশেষ করে টিস্যু পেপার হাওয়া হয়ে যাওয়া, স্যানিটাইজার উধাও- এসব জন স্বভাবের মানকে প্রতিফলিত করে। তার পরও পৃথিবীতে মানবিক আত্মার ডাক শোনা যাচ্ছে। বাজারী সভ্যতার যুগেও অস্থির হয়ে থাকা মানুষের চেতনার গভীরে অস্পষ্ট মানবিক আত্মার ডাক শোনা যাচ্ছে।  পাশে থাকা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। উদাসীন রাষ্ট্রের অপেক্ষা না করে ব্যাক্তিগণই প্রথম মানবিক আওয়াজ দিয়ে পাশে থাকার প্রত্যয় দেখিয়েছে। স্পষ্টত সে আওয়াজে দেশ-ধর্মের ভেদ নাই, নারী-পুরুষ নাই, শুধুই মানুষ আর মানবিকতা। হৃদয়ের গভীরতর খাঁদে লুপ্ত থাকা বৌদ্ধিক কন্ঠ শোনা যাচ্ছে - যে খাঁদে অলক্ষ্যে অশ্রুপাত হয় সিরীয় শিশুর জন্য, আফগান রাখালের জন্য, ফিলিস্তিনের বালকের জন্য,লক্ষ কোটি শরণার্থীর জন্য, অনাহারী আফ্রিকানদের জন্য...। খাঁদে নিমজ্জিত সে বোধের প্রকট হওয়া নতুন সূর্যোদয়কে নিশ্চিত করবে।

এ সংকটের সর্বোচ্চ শাস্তির মাত্রা এখনো অনির্ণেয়। এর পর আমরা- অধিক বর্বরতায় পর্যবসিত হবো নাকি মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলবো? চীন কেন্দ্রীক নয়া বলয় তৈরি হবে নাকি পুরনো মোড়লই যুদ্ধের হুংকার দেবে? সামাজিক অস্থিরতা আর আত্মহত্যা কি আরও বাড়বে? ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানগণ সিভারলি ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে উঠবে আর আন্ডার ওয়ার্ল্ড থেকে কোন মাফিয়া ডন পৃথিবীর ঘন্টা বাজাবে? নাকি বিজ্ঞানের আলোয় পথ চলবে পৃথিবী, মনুষ্যত্বের জয় গান গাইবে?

ড্রামাটিক কোন চেইঞ্জ হয়তো আসবেনা। তবে এ মহামারী পরবর্তী আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে আঞ্চলিক জোট সমূহ বৃদ্ধি পাবে। বৈশ্বিক জোট ও বৈশ্বিক সংস্থা সমূহ ঘন ঘন রিপোর্ট পেশ করবে, বৈঠক ডাকবে। মানবাধিকার নিয়ে আরও ব্যাপক আলোচনা, আন্দোলন শুরু হবে। করোনা কালের পূর্বে এবং চলমান সংকট সমূহ নির্মূল হবেনা, রিডিউস হবে এবং উদ্ভট গ্যাটিস বা জোড়াতলি শুরু হবে। একটা grammatical solution এ আসতেই হবে। চোখের সামনেই তো জোট সমূহ বেকার হয়ে আছে, পথের অসারতা ওপেন হয়ে আছে। আদি ইউরোপীয় ডাকাত সঙ্ঘের চেয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সক্ষমতা কমে গেছে, অন্তন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের ইউরোপীয় ইউনিয়নকে রূপকথা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটাই প্রকাশ পায়।

লিডারের কাজ সচিব করতে পারেনা বা সে দায় টুকুও থাকেনা। বৈশ্বিক মহা সচিবের বর্তমান কর্মতৎপরতা ও ভূমিকা দেখেই তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কাজেই সচিব বা আমলা নির্ভরতা নয় বরং জন প্রতিনিধি নির্ভরতায় জাতিসংঘ তার নির্বাক ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আঞ্চলিক জোট গুলোও যুক্তিযুক্ততা পাবে সে পথেই। আর এটা বাস্তবায়িত করতে গেলে বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামো অনিবার্য হয়ে উঠবে, ব্যকারণিক সমাধানটাই মূখ্য হয়ে উঠবে।

এখনতো মৃতের মুঠোয় বন্দী জীবন।

১৬.০৫.২০২০

Friday, May 15, 2020

কামারের বিলাই - ভূবন মুন্সী



নায়ক মান্না অভিনীত ‘দাঙ্গা’ ছবির প্রথম দৃশ্যের গল্প- এক কামারের একটা বিলাই ছিলো; বিলাইডা সারাদিন ঘুমাই থাকতো; লোহার ঠন ঠন ঠনাস ঠনাস শব্দেও তার ঘুম ভাঙতো না; কিন্তু কামার যহন ভাত খাইতে বসতো তখন মাছের কাঁটা চিবানোর শব্দে তার ঘুম ভাইঙ্গা গেতো।

গল্পের মানে হইলো, যার যা দরকার, সে তার খবর রাখে।

প্রমাণ দিতে গিয়ে এক অনাথ কে জিজ্ঞেস করে, কাল রিলিফের চাল দিবে সে খবর তার জানা আছে কিনা,
উত্তর আসলো ‘না’।

নাপিত বললো,
কথাডা মিথ্যা হয়া গেলো বাবু। এডা কামারের বিলাই না।

ঠিক তেমনি দেশ মাতৃকার দুর্দিনে, যাঁরা দেশের তারা খবর রাখে। একুশ হতে একাত্তরে তারা ঠিকই জেগে উঠে ছিলো, ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতায় সাতান্নোর নিভে যাওয়া সূর্য বুকের বারুদে আবার জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ডিসেম্বরে।

আজ অর্ধ শতাব্দী পর আবার যখন পুরনো প্রেত, আরব্য জাহেলিয়াত তান্ডব ছন্দে নৃত্য করছে দেশের সবুজ ক্যানভাসে, তখন দেখি সবাই কন্ঠহীন-বোবা, ঘুমিয়ে থাকা অকামারী বিড়াল।

চলমান সামাজিক-রাষ্ট্রিক সংকটে, যাঁরা দেশের আজ তাঁরা জাগবে। দেশদ্রোহী পাষন্ডের বিপরীতে কেউ তো আছেন দেশজ চেতনায় অন্বিত বীর সৈনিক, কেউ তো আছেন “কামারের বিলাই”।


০২.০৩.২০১৯

Thursday, May 14, 2020

বৈশ্বিক সংকট এবং সমাধান ভাবনা - ভূবন মুন্সী


সামগ্রিক পৃথিবী দেখার প্রশ্নে মগজ মর্টগেজ রাখলে চলবে না।
.........................................................................................


পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল, আর স্থলের সবটা করোনার আশ্রম!


বিশ্বায়নের এ যুগে ভাইরাস যে রকোটক গতিতে ছড়িয়ে পড়লো সারা বিশ্বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহামারি না ছড়ানোর জন্য ‘কোয়ারিন্টিন’ এবং ‘লক-ডাউন’ পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। প্রতিকারের জন্যও কোন সুসংবাদ খুব দ্রুতই শোনবো, এমনটা আশা করতেই পারি বিশ্বস্থ বিজ্ঞানের কাছে। আর তথ্যের আদান প্রদান, বিশ্লেষন করে আমরা মহামারীকে রুখতে পারবো এটাও আশা রাখি।

ইয়োভাল নোয়াহ হারারির কাছ থেকে জানি, “এইডস কিংবা ইবোলার মতো ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলেও ইতিহাসের অন্য যে কোন মহামারীর তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসব ভাইরাসজনিত মহামারী অনেক কম সংখ্যক মানুষের প্রাণনাশ করতে পেরেছে। এর কারণ, জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের মূল প্রতিরক্ষাটা হয়ে উঠেছে তথ্য বিনিময়, পৃথক থাকা নয়। মানবজাতি মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় অব্যাহত রেখেছে, এর কারণ, জীবাণু বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা জীবাণুর অন্ধ পরিব্যাপ্তির উপর নির্ভর না করে নির্ভর করছেন তথ্য-উপাত্তের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর।”৩

পুরনো রথ এখনো পিছনে টেনে ধরে আমাদের। এখনো কিছু বন্ধাত্ব্যে দীর্ণ মানুষ প্রস্তুত হয়ে থাকে সভ্যতার সম্মুখগামী রথটাকে পিছনে টেনে ধরার জন্য। এখনো মন্ত্র, ওঝা, তাবিজ, কবজ, মল-মুত্র দিয়ে সমস্যার চাকু রুখতে চায়। “আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত এসব রোগের জন্য মানুষ দায়ী করত ক্ষুব্ধ প্রভু, হিংসুটে শয়তান কিংবা দূষিত বায়ুকে। কিন্তু কোন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে তারা সন্দেহ করত না। মানুষ তখন বিশ্বাস করত, জ্বীন-পরীর উপস্থিতিতে এসব ঘটছে। কিন্তু তারা ভাবতেই পারত না একফোঁটা পানির মধ্যে থাকতে পার প্রাণসংহারক জীবাণুর বহর। সে-কারণে যখন ‘ব্ল্যাক ডেথ’ কিংবা গুটিবসন্ত আক্রমণ করত, তখন কতৃপক্ষ সর্বোচ্চ যে ব্যবস্থা নিত তাহল, বিভিন্ন প্রভু কিংবা সাধকের উদ্দেশ্যে গণপ্রার্থনার আয়োজন করত। এতে কোন লাভ হত না। বরং গণজমায়েতের ফলে আরো অনেক বেশি মানুষ সংক্রমণের শিকার হত।”৪. “বুজুক্খোর-ই বুড়ো ভীমরতি ছিলো আছে থাকবে”৫. তবে অধিকাংশ মানুষে এটা আজ প্রতিষ্ঠিত, “কোন ধর্মীয়, অধর্মীয়, প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে এই মহামারীকে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বানের জলের মতো সবার ঘরেই ঢুকে পড়ছে ভাইরাস আতঙ্ক। স্রষ্টার কাছে মুক্তি চেয়ে সাময়িক মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমলেও শেষ ভরসায় রাষ্ট্রগুলো তাকিয়ে আছে সাইন্স-ল্যাবরেটরি গুলোর দিকে।”৬

মানবাজাতি আজ শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসেই আক্রান্ত নয়, তারা আজ নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের ভয়াবহতারও শিকার। একটা মহামারির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে জনগণের উচিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে বিশ্বাস করা। নাগরিকদের উচিত তাদের সরকার ও কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করা এবং রাষ্ট্রের উচিত একে অপরকে বিশ্বাস করা। গত কয়েক বছর ধরেই দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা সুচিন্তিতভাবেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষ, জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বকে হেয় করে আসছেন। ফলস্বরূপ, আমরা এই ক্রান্তিকালটা পার করছি কোন নেতৃত্ব ছাড়াই।”৭.  সত্যিকার অর্থে নায়ক গণই  তো দেশ চালাচ্ছেন। নেতৃত্ব নেই এ কথা সত্যি হলো কি! তবে মহাশয় যা বুঝাতে চাচ্ছেন, তাতে মনে হলো তিনি আরও যোগ্য কোন নেতৃত্বের কথা বলছেন, যারা হবে হয়তো সৎ, মানব দরদী, দেশ প্রেমিক ইত্যাদি। কিন্তু দেশে দেশে সৎ, মহৎ নায়কদের মসনদে বসিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান দিতে পারবে? অধ্যাপক হারারি বিশ্বায়নের সমস্যা সমাধানের জন্য, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থের জন্য আমেরিকার এগিয়ে আসা বা পিছিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন, বা অন্য কেউ (আমেরিকার মতো স্বঘোষিত মোড়ল) এসে সে স্থান পূরণ করুক সে প্রত্যাশা রাখছেন।

স্বর্ণের দর পতন, শেয়ার বাজারের সূচক নিম্নগামী। করোনা আক্রমনের সাথে সাথে অর্থনীতির দেশে সংকটের জন্ম হয়েছে। লক ডাউন মেরে ভাইরাসের লাগাম টেনে ধরা গেলেও, লক ডাউন শেষে অর্থনীতির ঘোড়াতে লাগাম পরাতে বেগ পেতে হবে। অর্থবাদী ঝোঁকের কারণেই তো সভ্যতার চলতি ঘোড়া খাদে পড়ে রয়েছে।

দ্রষ্টব্য এই, “ পল ক্রগম্যান, যিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ভূগোল গবেষণা সমন্বিত করা কিংবা মার্কিন রাজনীতির মধ্য থেকে বিশ্বায়নের বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষেণ করারর অবকাশ থেকেই হোক, স্পষ্ট ভাবেই প্রচলিত মার্কিন বিধি বিধনি গুলো সংস্কারসহ অর্থনীতিকে রাজনীতির অনুসারণকারী হিসেবে দেখিয়েছেন অর্থাৎ অর্থনীতির আগে রাজনীতিকে স্থাপন করেছেন, সেই তিনিও কিন্তু বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে বৈশ্বিক কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রুপকল্পের কথা বলেননি। পাশ্চাত্য আজ আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সাংস্কৃতিক বা বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেও অর্থবাদী প্রবণতা দ্বারা আক্রান্ত।”৮

মহামতি কার্ল মার্ক্স যন্ত্রের অভিঘাত দেখলেও অর্থবাদী ঝোঁকের কারণে দার্শনিক চোখে বুঝে উঠতে পারেননি,৯, পল ক্রগম্যান অর্থনীতিকে রাজনীতির অনুসারণকারী হিসেবে দেখিয়েও, বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে বৈশ্বিক কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রুপকল্পের কথা বলতে পারেননি, অধ্যাপক হারিরি মহোদয়ও বিশ্বায়নের অনেক বিশ্লেষণ দিয়েও অবিশ্বায়িত কোন মোড়লের কাছ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না। সেলুকাস!!

আজ সংকট কোন দেশ সীমানায় আবদ্ধ- তা কিন্তু নয়, এটা আজ বৈশ্বিক। সমগ্র দুনিয়া অস্থিরতায় টালমাটাল; সংঘাত, দ্বন্ধ, খুন, ধর্ষন আর আত্মহত্যার প্রবল প্রতাপ সামাজিক চরাচরে, সব সমস্যা কিন্তু জাত, বর্ণ, ধনী, নির্ধনী বিচার করেবনা (যে কারো ঘরে, যে কোন দিন ঢুকে যেতে পারে)। একক বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া সব কিছুকে ট্যাকেল করা ব্যাক্তি নায়কদের পক্ষে সম্ভব কি?

প্রাযুক্তিক বিকাশে এটা আজ স্পষ্ট সমগ্র মানুষের জন্য একটিই পৃথিবী, লাব্ববাইক কন্ঠের অধিকারী শুধুই মানুষ, নষ্টকে নষ্ট বলার বোধ কিংবা মানিনা বলতে পারা অথবা সুন্দরকে ধারন করা বা নতুনকে মেনে চলার সক্ষমতা শুধুই মানুষের।

নষ্ট সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার দায় কিংবা যথার্থ সূর্যটাকে খুঁজে এনে ভোর উঠাবার বীরত্ব শুধুই মানুষের।

ভালোটা তরঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে যায় সমগ্র ভুবন, তেমনি মন্দটা বিষ হয়ে বিষিয়ে দেয় সবার যাপন। বেঁচে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার একটিই কিশতি আজ, ভালো বা মন্দ সবটা সবার সাথে একাকার।

মহাবিশ্বের এই সবুজ কিশতিতে অখন্ড মানবিক বোধে আমরা হয়ে উঠি একজন- ইউনিটি অব ম্যান।প্রত্যহ খুঁজে আনি যথার্থ সুন্দর, যথার্থ সূর্য সকাল।

২১.০৩.২০২০
এডিট-১৪.০৫.২০২০

তথ্যসূত্রঃ
১. কহতব্য।
২. worldometer.
৩. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৪. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৫. দুঃখ দহিত মুখ।
৬. মা-নু-ষ পেজ হতে।
৭. করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবজাতি নেতৃত্বশূন্য।
ইয়োভাল নোয়াহ হারারি।
৮. কহতব্য।
৯. মার্ক্স ও এঙ্গেলস

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান


ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ডঃ কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

জন্ম - ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭
বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু - ১৪ মে ২০২০
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ

পেশা - লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ

জাতীয়তা - বাংলাদেশী

নাগরিকত্ব - বাংলাদেশ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।