Wednesday, July 8, 2020

নতুন সকালের প্রতীক্ষায় ( পার্ট - ২) - মোঃ শামীম রেজা

[নোট : "নতুন সকালের প্রতীক্ষায়" লিখাটি দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সম্মানিত পাঠকদের অনুরোধ পার্ট - ২ পড়ার পূর্বে পার্ট - ১ পড়ে নিবেন]

এ্যাডাম স্মিথের আগে বণিকবাদী অর্থনীতির  যে রাষ্ট্রীয়  দর্শন ছিল তার উপর দাঁড়িয়ে গোটা ইউরোপ তাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতি গ্রহন করেছিল এবং সেই মোতাবেক কার্যাবলী পরিচালনা করতো। এমনকি মোটা দাগে বলতে গেলে নয়া সাম্রাজ্যবাদ নীতিতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরেও এই প্রক্রিয়া চালু ছিল এবং বাজার দখলের নীতিতে সেই সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিই বহমান, মূলগত অর্থে বহাল আছে।

বণিকবাদী অর্থনীতির দর্শন ছিল নিজ দেশের উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করতে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় আর আমদানি হবে সর্বনিম্ন মাত্রায় সম্ভব হলে একেবারে আমদানি না করা ।

সেখান থেকে ইউরোপের দেশগুলো ছড়িয়ে পরে আফ্রিকা এবং এশিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। বাণিজ্যের নামে ধূর্ততা, দস্যূবৃত্তি,চৌর্যবৃত্তি কি করে নাই তারা? এ ইতিহাস খুব বেশি দিন আগের নয়।

১৭৭৬ সালে এ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ অফ ন্যাশন বইটা প্রকাশিত হয়। এই বই এ এ্যাডাম স্মিথ শুধু অর্থনৈতিক নতুন তত্ত্বের কথা ই বললেন না বরং উৎপাদন পদ্ধতি, সম্পদের মালিকানা ব্যবস্থা, সম্পদ বন্টন ব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সহ বিনিময়, বাজার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বিনিময় সম্পর্কের ধরণ ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলেন এবং অর্থনীতির ভিত্তি কৃষি থেকে সরিয়ে শিল্পের উপর দাড় করানোর কথা বললেন। তার অদৃশ্য হাত এখনও বাজার ব্যবস্থায় চালান হচ্ছে!

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব হয় সাম্য,মৈত্রী ও স্বাধীনতা এই তিন মূলমন্ত্র কে আধেয় করে। রাষ্ট্রীয় পরিচালনা পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সহ টোটাল সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটা পরিবর্তন এলো।
প্রযুক্তির উন্নয়নে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল এসময়।

এদিকে ভারতবর্ষে তখন কি ঘটতেছিল? যেখানে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব হয়ে গেল ইউরোপে এবং কৃষককে মুক্ত করে দেওয়া হলো ভূমিদাসত্ব থেকে সেখানে ভারতবর্ষে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু দেশজ বাস্তবতার নিরিখে হতে পেরেছিল? এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্কটা কি বৈশ্বিকভাবে ইতিবাচক ছিল?

এরপর বাংলাদেশ নামক যে ভূ-খন্ড রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হলো তার উন্নয়ন ভাবনা, নীতি দেশজ বাস্তবতা পেয়েছে কিনা সেটা কেন্দ্র থেকে গ্রহন করা নীতি সমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের জীবনে কতটুকু ইতিবাচক  প্রভাব রাখতে পেরেছে তা পরিসংখ্যান বলবে বিশেষত সমসাময়িক সময়ে পৃথিবীর আরো কিছু রাষ্ট্রের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অগ্রগতি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে সে সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।

এখন বৈশ্বিকভাবে ৪ র্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে।। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের বেশ কিছু প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে যেমন
- ২০২৫ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন সংযোগ তৈরির সম্ভাবনা

- অটোমেশনের কারণে চাকরির ঝুঁকি বাড়বে (যুক্তরাষ্ট্র: ৩৮% – ৪৭%, জার্মানি: ৩৫%, ব্রিটেন: ৩০%, জাপান: ২১%)

এর বাইরে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের কিছু চ্যালেঞ্জ এর কথা বলা হচ্ছে-

- তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ

- প্রযুক্তিগত সমস্যায় উৎপাদনে ব্যাঘাত

- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা

- ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত সংযোগ নিশ্চিত

অটোমেশনের কারণে বহু মানুষের কাজের সুযোগ হ্রাস
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যেসব সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে

- অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস

- উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি

- স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন

- বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি

- সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

বাংলাদেশ আসলে কোন পথে হাটছে? করোনা পরিস্থিতি ৪র্থ শিল্প-বিপ্লবকে আরো বেশি শক্তিশালি করেছে এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিণতি (যা উৎপাদন ব্যবস্থার আল্টিমেট পরিণতিও বটে) ঘটার কথা বলা হচ্ছিলো সেটাই করোনা পরিস্থিতি দ্রুত বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ উপনিবেশ শাসিত দেশ হওয়ায় এদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিক চিন্তা কাঠামো চিন্তা পদ্ধতি এখনও উপনিবেশের ভূত দ্বারা পরিচালিত হয়।

উদ্ভূত এই বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতে বাংলাদেশের হাতে কি কোন নিজস্ব তত্ত্ব বা কাঠামো আছে যা এদেশ এবং দিশাহীন হয়ে পড়া নেতৃত্বহীন দুনিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিশা দেখাতে পারে?

কোন শর্তেই পৃথিবীকে আর বিভক্ত করা যাবে না
কোন অর্থেই মানুষকে আর উচু-নিচু ভেদে বিচার করা যাবে না।

বাংলাদেশকে এর প্রস্তুতিটা নিতে হবে যথাযথ ভাবে। দুনিয়াতে মারনাস্ত্র দিয়ে শাসন করার যুগ শেষ অথবা জাতীয়বাদ বা বৈশ্বিকতাবাদের যে উদারবাদী তত্ত্ব জ্ঞানকান্ডের সে ডিসকোর্সও সেকেলে হয়ে গেছে লকডাউনের এই কয় মাসে।

সুতরাং

প্রস্তুতি এবং প্রতিরক্ষার জায়গাটা হলো এখন জ্ঞানচর্চার জায়গাতে। এজন্য রাজনীতিটা সুস্থ এবং জনগন মুখি হয়ে দেশজ বাস্তবতায় হওয়া দরকার। ইউরোপীয় আলোকায়নের জ্যোতি আমাদের যৌথ জীবনের যে মৌলিক মানবিকতা বোধের শিকড় তা উৎপাটন করে ব্যক্তিবোধের ঘৃণ্য পারস্পারিকতাহীন অসামাজিক দায়হীনতার বোধকে সেঁটে দিয়েছে বাজারী ভোগ-বিলাসীতার প্রবৃত্তি দিয়ে। এখান থেকে শিক্ষা-জ্ঞান-মানবিক চর্চার এই এ্যাকাডেমিক মূল্যবোধ থেকে বের না হতে পারলে আমাদের সামগ্রিক মুক্তি নেই। আর ইউরোপ তো ইতিমধ্যে জীবন এবং জগতের সম্পর্ক নির্ণয়ে বস্তুতে গিয়ে থেমে আছে। তাদের ও বের হওয়া প্রয়োজন এই জট থেকে।

৪র্থ শিল্প বিপ্লব হোক নতুন মানবিকতার স্লোগানে
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ হোক উন্নয়নের শর্তে সর্বাগ্রে বিবেচিত। করোনার এই মহামারি বিশ্ব নেতৃত্বকে, মানচিত্রিক সীমানায় রাষ্ট্র গুলোকে এবং বৃহত্তর সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সমূহকে তেমন শিক্ষাই দিয়ে যাক বিশ্বের এই অহিংস ভাইরাসঘটিত মৃত্যুগুলো। পৃথিবী করোনা পূর্ববর্তী মানবিকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আরো উন্নত মানবিকতার স্তরে প্রবেশ করুক। নতুন সকালের প্রতীক্ষায়।

1 comment:

  1. উত্তর ঔপনিবেশিক রাজনীতির ভাব ও ভাবনাবহুল গদ্য...

    ReplyDelete