Sunday, July 12, 2020

আমাদের পৃথিবী : একবিংশ শতাব্দীর দুই দশক - ভূবন মুন্সী।


শুরুতে সমাপ্তির গল্প:

 

"This is a small step for man, but a giant leap for the mankind." হ্যাঁ, ছোট পদক্ষেপ। কিন্তু  রূপকথার মতোন। ১৯৬৯ সন। ২০ জুলাই। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চাঁদে প্রথম পা রাখবে মানুষ। নীল আর্মস্ট্রং ইতিহাস হয়ে যাবে। রূপকথার নায়কের মতোন নীল আর্মস্ট্রং আজ ইতিহাস। কিন্তু এটাই সবটা নয়। গত শতাব্দীতে ঘটে গেছে আরও সুন্দর এবং কুৎসিত ঘটনা সব। ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশে দেশে। আবার দেশে দেশে ডানা মেলেছে স্বাধীনতার রকমারী ঝান্ডা। ঘটে গেছে ভয়ংকর ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ। মানুষ দেখেছে নিউক্লিয় শক্তির শিব তান্ডব : হিরোশিমা, নাগাসাকি। প্রত্যেক মুহূর্তে শঙ্কা জাগিয়েছে স্নায়ু যুদ্ধ। ঘটে গেছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং : বেড়ে গেছে সি লেভেল। আমরা দেখেছি প্রযুক্তির উল্লম্ফন পর্ব, মিডিয়ার রেভুলেশন। মানুষ হয়তো আজীবন পৃথক থাকার জন্য গড়ে তুলেছিলো বার্লিন প্রাচীর, আবার ভেঙে ফেলেছে। হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম এবং মৃত্যু। ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধারণা আজও লাগামহীন গতি নিয়ে ছুটছে। কোথায়, কোন গন্তব্যে ছুটছে?

মোমবাতির মতোন গলতে থাকলো টুইন টাওয়ার:

 

৯/১১. আগুন ও মৃত্যুর স্মৃতি। তখন সকাল। স্থানীয় সময় ৮:৪৬. শতাব্দীর শুরুতেই বুক পিঠে ছিদ্র হলো টুইন টাওয়ার। লাশের মিছিল গুণতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলো পৃথিবী। সহস্রাব্দের বরণ বাতি তখনো নেভেনি। অথচ মোমবাতির মতোন গলতে থাকলো টাওয়ার। এ আগুন নেভাতে গিয়েই প্রেসিডেন্ট বুশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আওয়াজ দিলেন। তারই পথ ধরে ধ্বংস স্তুপ হলো আফগানিস্তান, ইরাক এবং আরও। ২০১১ সালে আমেরিকান নেভী সিলের হাতে ওসামা বিন লাদেন এর মৃত্যু হলো। কিন্তু শতাব্দীর সন্ত্রাসবাদের আগুন এখনো নিভলো না। সাদ্দাম হতে বাশার কিংবা ইরাক হতে সিরিয়া আগুন জ্বলছেই।

টুইন টাওয়ার হামলা

চিচিং ফাঁক এবং আলাদিনের চেরাগ:

 

আলিফলায়লাটিক চেইঞ্জ। প্রয়াত পিতাগণ এটা কল্পনাও করতে পারেনি। স্টিভ জবসের হাতে  ২০০১ সালে আইপডের যাত্রা। ২০০৪ এ জাকারবার্গের হাতে ফেসবুকের জন্ম। আজ ২৪৫ কোটি মানুষের ফেসবুক পরিবার। ২০০০ সালে শুরু হওয়া জিপিএস আজ অনায়াসেই খুনিকে ধরে ফেলছে। মানুষের হাঁচি আর কাশি দুটুর কারণই শনাক্ত করে ফেলছে যন্ত্র। স্মার্ট ফোনের বদৌলতে পৃথিবীটা আজ হাতের মুঠোয়। কি সহজে প্রযুক্তির দৈত্যটা সব ইচ্ছা পূরণ করে দিচ্ছে মুহূর্তেই। অচেনাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। অজানাকে জানিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছা গুলোও বুঝতে সময় নিচ্ছে না। চিচিং ফাঁক মন্ত্র উচ্চারণের সময়টুকুর চেয়ে দ্রুতগামী আজকের প্রযুক্তি। আলিফলায়লাটিক পৃথিবী।

পানির খোঁজে মঙ্গলে, পৃথিবীতে প্রাণের সংকট:

 

মহাকাশ তন্ন তন্ন করে চষে ফিরছে মানুষ। চাঁদের পর মঙ্গল, অগ্নি দানব সূর্যের দিকেও তল্লাশি চালাচ্ছে পৃথিবী। অথচ কি বিস্ময়! পৃথিবীতে প্রাণের সংকট। আর মানুষ নিজেই স্ব-বিনাশের কারণ। আপাত চোখে এটা মানুষের স্ববিরোধী আচরণ। বস্তুত দেখতে যতটা  নিরীহ মনে হয়, মানুষ ঠিক ততোটাই চতুর ও হিংসাত্মক। মঙ্গলে জল পাওয়া গিয়েছে ২০১৮ সালে। এটা নিয়ে মিডিয়ার হৈচৈ।  অথচ এ সালের হিসেব মতেই শতকরা ৯.২ জন মানুষ চরম খাদ্য সংকটে। সেলুকাস! গত শতাব্দীতেও মানুষ দেখেছে ভারতে বৃটিশদের নারকীয় শাসন। দেখেছে মানুষ কেমন করে  আকাল আর দুর্ভিক্ষ প্রসব করে।

প্লুটো বিদায় নিলো সৌর পরিবার হতে, স্টিফেন হকিং পৃথিবী হতে:

 

২০০৬ সন। প্লুটো সৌর গ্রহ পরিবার হতে বিদায় নিলো। একই বছর ইন্ডিয়ার মুম্বাইয়ে ট্রেন বোম্বিং। ২০৯ জনের মৃত্যু। সদ্য লাঞ্চ করা টুইটারে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। আজ শোক সংবাদগুলো খুব দ্রুতই সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কখনো বুআজিজি বসন্তের আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সোসাল মিডিয়ায়। কাঁপিয়ে দেয় আরব অঞ্চল। শুধু প্লুটো নামক গ্রহ নয়, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্গারেট থ্যাচার, স্টিফেন হকিং কিংবা মাইকেল জ্যাকসনের মতোন অসংখ্য নক্ষত্র এই দুই দশকের মধ্যেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

সুনামির তান্ডব, ফ্লু এবং বৈশ্বিক মন্দা:

 

২৬শে ডিসেম্বর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ। স্থানীয় সময় ৭:৫৮:৫৩, সূর্য মাথা তুলেছে মাত্র। ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলো ১৪টি দেশে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২২ লক্ষ ২৭ হাজার। দুহাজার দশের হাইতির ভূমিকম্পে মারা গেলো ২ লক্ষ ৩০ হাজার। আহ্। কী দীর্ঘ মৃত্যুর মিছিল। সে বছরই লাঞ্চ করা ইনস্ট্রাগ্রামে ভাইরাল সব শোক ছবি। বাংলাদেশের রানা প্লাজার সেই শ্রমিকদের বেঁচে থাকার আর্তি আজও বাতাসে ভাসে। ২০০৭-০৮ সনের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা। ৮৭ লক্ষ মানুষ চাকরিচ্যুত। শ্রমিকরাই সব সময় বেশি বঞ্চিত হয়। তারাই বেশি আক্রান্ত হয় সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা কিংবা করোনাতে। ভাইরাস কিংবা ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা মানব সৃষ্ট বঞ্চিতরাই বেশি বঞ্চিত হয়। বৈষম্যের চাকা থামবো কখোন?

করোনার পর সকলে স্পষ্ট হলো নেতৃত্ব শূন্য পৃথিবী:

 


প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা
বেনগাজীতে গাদ্দাফির পতন। আরেক গাদ্দাফির মসনদ আরোহন। বুশ কিংবা ক্যারিশমাটিক ওবামা, দিন শেষে দেখলাম তফাত নেই। যখন মোড়ল রাষ্ট্রে একজন খাঁটি বণিক ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট বনে গেলেন, তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না মতাদর্শিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে নেতৃত্ব শূন্য পৃথিবী। মূলত বণিকরাই বিভিন্ন বেশ ধরে পূঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা চালু রাখছেন দেশে। কলম কিংবা বন্দুক, কিতাব কিংবা খেতাব সবটাই পণ্য হয়ে গেছে।

পৃথিবীর জিভে ক্ষত, নৈতিক সংকট, অস্থিরতা:

 

First genetically modified children were born on November, 2018! এটা খুবই বিস্ময়! মানুষ জীবনের মর্মমূলে হাত দিতে সক্ষম। টেস্ট টিউব বেবি, জেনেটিক বেবি, অধিক ফলনশীল শস্য সবটা বিস্ময়কর। তবু মানুষ কি আজও হৃদয় ছুঁতে পেলো? আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবী। অথচ আত্মহত্যার লাইন ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। সভ্যতা এগিয়েছে পোশাকে। ভেতরে ভেতরে এসেছে নগ্নতা। ওপেন সেক্স, ড্রাগ, ব্রোকেন ফ্যামিলি, সমকামী কোন নিক্তিতে এগুলো বৈধতার লাইসেন্স পেতে পারে? তবুও পেয়ে যাচ্ছে। এখানেই কথিত গণতন্ত্রের গলদ। মন্দটা আইডেন্টিফাই করা গেলেও সাংখ্যিক জোরে থামানো যায় না। Nation is in sleeping pils and sex disease. পৃথিবীর জিভে ক্ষত। জীবনের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না আজকাল। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন তো পৃথিবীর জৈবিক জিভে ক্ষত হয়ে সেই কবে থেকে জিইয়ে আছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন, জাতীয়তাবাদ ও পুঁজিবাদ সমেত পৃথিবী মৃত্যু শয্যায়:

 

১৯৫০ সালে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের যাত্রা শুরু। একবিংশের সাথে সাথে যাত্রা করেছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। জাতীয়তাবাদের মন্ত্র পাঠে পৃথিবীতে মানুষ একদিন ভেঙেছে পরাধীনতার শিকল। জন্ম দিয়েছে নয়া শৃঙ্খলার। পুঁজিবাদও একদিন পৃথিবীকে নিয়ে বিকাশের পথে হেঁটেছে। শৃঙ্খলা পুরনো হয়ে গেলে সেটা আবার শিকল হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদ ও পুঁজিবাদ দুটোই আজ পায়ের শিকল। মানুষের বিকাশ ও ভালো থাকার অন্তরায়। এ দুই ব্যাকডেটেড মন্ত্র হাতে নিয়েই কতিপয় চালাচ্ছে পৃথিবীর উপর বর্বরোচিত বলাৎকার।  মাটি মুখ বুঝে সইতে পারে, জলবায়ু বড্ড জেদী। নিজেকে পাল্টে নিয়ে সে আজ বিপন্ন করে দিচ্ছে পৃথিবীর মানব জীবন। ভাইরাস থেকে ভূমিকম্প সবটা নিয়েই প্রকৃতি খড়গহস্ত। নতুন নতুন মহামারী আর পিছু ছাড়ছেনা।

পৃথিবী বিনির্মানের আহবান:

 

কে জানতো বসন্তের আগুনে পুড়বে নিউইয়র্ক! সেই টুইন টাওয়ার। দুই দশক পূর্বের কথা। দুই দশকের প্রান্তে এসে আঘাত হানলো করোনা। অথচ সেদিনের মতোন আজও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের প্রস্তুতি চলছিলো। দুই দশক পূর্ব হতে পরিণতির দিকে পৃথিবীর যে যাত্রা আজ যেন তা পূর্ণ হলো। সেদিনের আংশিক থ্রেট খাওয়া পৃথিবী আজ একঘর, একাকার। প্রাযুক্তিক বিকাশে বিশ্ব আজ গাঁয়ের চেয়েও ছোট।

প্রাযুক্তিক বিকাশে এটা আজ স্পষ্ট সমগ্র মানুষের জন্য একটিই পৃথিবী, লাব্ববাইক কন্ঠের অধিকারী শুধুই মানুষ, নষ্টকে নষ্ট বলার বোধ কিংবা মানিনা বলতে পারা অথবা সুন্দরকে ধারন করা বা নতুনকে মেনে চলার সক্ষমতা শুধুই মানুষের।

নষ্ট সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার দায় কিংবা যথার্থ সূর্যটাকে খুঁজে এনে ভোর উঠাবার বীরত্ব শুধুই মানুষের।

ভালোটা তরঙ্গ হয়ে ছুঁয়ে যায় সমগ্র ভুবন, তেমনি মন্দটা বিষ হয়ে বিষিয়ে দেয় সবার যাপন। বেঁচে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার একটিই কিশতি আজ, ভালো বা মন্দ সবটা সবার সাথে একাকার।

মহাবিশ্বের এই সবুজ কিশতিতে অখন্ড মানবিক বোধে আমরা হয়ে উঠি একজন- ইউনিটি অব ম্যান। প্রত্যহ খুঁজে আনি যথার্থ সুন্দর, যথার্থ সূর্য সকাল।

১৩.০৭.২০২০

No comments:

Post a Comment