Wednesday, July 22, 2020

দেশীয় অর্থনীতি বনাম যোগান বিধি - মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল।

মাটির বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতি হয়ে যাপনে ফিরে। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে মাটির বৈশিষ্ট্যই যেন অধরা থেকে গেছে। আপন ভূপ্রকৃতি ও তার বৈশিষ্ট্য বুঝে এমন চোখ যেন অমাবস্যার চাঁদ। ফলে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও দেশের উন্নয়নের শর্তে শিল্পায়ন যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, ঠিক ততটুকুই অবহেলার দৃষ্টিতে থেকেছে কৃষিখাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক
মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল এর কলমে মেসেঞ্জার অব কসমোলজিতে উঠে এসেছে সেই সব সমস্যা ও সমাধানিক দিশা।

দেশীয় অর্থনীতি বনাম যোগান বিধি 


মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


এদেশের শতকরা প্রায় ৭০ জন লোক গ্রামে বাস করে। অদ্যবধি জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ আসে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে। তাই, গ্রামীণ অর্থনীতির আয়তন বৃদ্ধি কল্পে- কৃষি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ বিনিয়োগ ব্যতিত অর্থনীতির আয়তন বৃদ্ধি পায় না। আবার অর্থনীতির আয়তন না বাড়লে জিডিপি এবং প্রবৃদ্ধিও বাড়ে না। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে- বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির সাথে- জিডিপি বৃদ্ধির এক ঊর্ধ্বমুখি সম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমানে, বৃহৎ আয়তনের জাতীয় অর্থনীতি এবং জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার- বেসরকারি বিনিয়োগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। কারণ পূর্বেই জেনেছি, বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতিও এগোয় না। অতীতের যে কোনো সময় কে ছাপিয়ে বিনিয়োগ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে সরকার ইতোমধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

এদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের সিংহভাগই আসে মূলত সেবা খাতে তৎপরবর্তী শিল্প ও কৃষি খাতে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এদেশীয় অর্থনীতি কৃষি নির্ভরশীল।  ‘Based on Ecology’ তথা ভূ-প্রকৃতি অনুসারে এদেশ কৃষি নির্ভর, কৃষি প্রধান দেশ। সে অনুযায়ি বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ কৃষিতে বাড়ার কথা থাকলেও তা আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। বরং, শিল্প-অর্থনীতির (artificial-Economi) উপর বিনিয়োগ বাড়ছে দিনকে দিন।

অথচ, ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রবৃদ্ধি গতিশক্তি- টেকসই দারিদ্র বিমোচন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, বিশ্বব্যাংক বহুকাল পরে- ফলদ, পশুপালন, মৎস চাষের মতো উচ্চমূল্যের কৃষি খাতের দিকে মনোযোগী হতে বলেছে বাংলাদেশকে। এতে একদিকে কৃষকের আয় বাড়বে, অন্যদিকে পূরণ হবে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা। এছাড়া কৃষি খাতে ১০ শতাংশ আয় বাড়লে অকৃষি খাতে আয় বাড়ে ৬ শতাংশ। জমি, শ্রম, সারসহ কৃষি খাতের উপকরণ ব্যবহার করে প্রতিদান বা ফল যা পাওয়া যায় তাকে বলা হয়- টিএফপি (টোটাল ফ্যাক্টর প্রডাকটিভিটি)। দেড় দশকের (১৯৯৫-২০১০) পরিসংখ্যান অনুযায়ী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কৃষি খাতে মোট উৎপাদিকা শক্তি তথা টিএফপি সবচাইতে বেশি বাংলাদেশে- ২ দশমিক ৭ শতাংশ। গত এক দশকের ব্যবধানে কৃষি খাত থেকে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে- গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানে এখনো কৃষিই প্রধান খাত। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন- আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি যদি ৩ দশমিক ০৫ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশে উন্নীত করা যায় তাহলে অনায়াসেই ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব (সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ মে, ২০১৬)।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের আয়ের উৎস হলো কৃষি। কৃষি খাতই দেশের দারিদ্র বিমোচনে মূল ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কৃষিকে আরো উচ্চপ্রবৃদ্ধিশীল করার জন্য বাংলাদেশ এখনো খুব বেশী অগ্রসর হতে পারেনি।

ক্ষুদ্র আয়তনের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর্থিক মন্দার কবলে পড়ে উন্নত বিশ্ব যখন দিগ্বিদিক ছোটার উপক্রম তখন তার ছিঁটেফোটাও লাগেনি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল ৩০ জুন, ২০১৬ খ্রিঃ বিনিয়োগ বোর্ডের সেমিনারে ব্রেক্সিট ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব বিশ্লেষণে বলেন- ব্রেক্সিট, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ হলেও অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব যে ফেলবে না, তার উদহরণ স্বরূপ তিনি বলেন- ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ (সূত্র: সমকাল, ৩০ জুন, ২০১৬)। অর্থাৎ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ‘জোট বা ভোট’ এর হেরফেরগত বৈশ্বিক মন্দা বা অচলাবস্থা- এদেশীয় অর্থনীতির অভ্যন্তরে তেমন কোন রেখাপাত ঘটাতেই পারে না। আর এর কারণ শিল্প অর্থনীতি নয়- এদেশীয় অর্থনীতির মূলে রয়ে গেছে কৃষি ব্যবস্থাপনা।

বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে এদেশীয় অর্থনীতির কোথায় যেন রয়ে গেছে অল্প বিস্তরে ব্যাপক পার্থক্য। গত ১৭’ই মে, এনসিসি ব্যাংকের ২৩ বছরপূর্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে, বিনিয়োগ ও শেয়ার মার্কেট প্রাসঙ্গিকতায়- ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক- এ জেড এম সালেহ, তাঁর ভাষায়- ‘অদ্ভুত অর্থনীতি আমাদের’ (সূত্র: বিডি নিউজ ২৪ ডটকম, ১৭.০৫.২০১৬)।

আর এ অদ্ভুত অর্থনীতির স্বরূপ’ই বা কিরূপ? তা অনুসন্ধানে- ‘এডাম স্মিথিয়’ বা ‘স্যামুয়েল্সীয়’ ধারার দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে এদেশীয় অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য বা মোজেজাটাই ‘উদ্ভট’ বা ‘অদ্ভুত’ অর্থে প্রতিফলিত হয়েছে। হিমালয়ের স্বচ্ছ জলপ্রবাহ, পলি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান বঙ্গ তথা এদেশীয় ভূ-বৈশিষ্ট্য কে দিয়েছে এক অনন্য উর্বরা শক্তি। অর্থাৎ ভূমি বৈশিষ্ট্য ও ভূমি ব্যবস্থাপনা (চাষ-বাস)’ই যে এদেশীয় অর্থনীতি ও উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি তা পাশ্চাত্য তথা ‘এডাম স্মিথিয়’ বা ‘স্যামুয়েল্সীয়’ ধারার অর্থনীতিতে উপেক্ষিত। তাই এদেশীয় অর্থনীতির মোজেজা- চাষা-ভূষা তথা সর্ব সাধারণের কাছে বোধোদয় হলেও, অধরা থেকে যায় অর্থনীতির বিজ্ঞজনদের কাছে।

এদেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতি প্রাথমিক ধারনা বা অর্থনীতির মোজেজা- অর্থনীতির বিজ্ঞজনদের কে হাতে-কলমে বোঝানোর জন্য ‘যোগান বিধির’ আশ্রয় নিলে বিষয়টি সহজে বোধোদয় হয়ে ওঠবে। যোগান বিধি অনুসারে- দাম বাড়লে, যোগানের পরিমান বাড়ে। এখানে দামের ক্ষেত্রে উলম্ব রেখায় ‘কৃষি উৎপাদন’ আর যোগানের ক্ষেত্রে ভূমিজ রেখায় ‘এদেশীয় অর্থনীতি’ কল্পনা করলে দাড়ায়- ‘কৃষি উৎপাদন’ বাড়লে, ‘এদেশীয় অর্থনীতি’ বাড়ে অর্থাৎ সমৃদ্ধ হয়। এটাই এদেশীয় অর্থনীতি।


লেখচিত্র : কৃষি উৎপাদন বনাম এদেশীয় অর্থনীতি।


যোগান বিধি অনুসারে- এদেশীয় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদনের পরিবর্তন হলে এদেশীয় অর্থনীতির পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে এদেশীয় অর্থনীতির উর্ধ্বমুখি সম্পর্ক বিদ্যমান। অন্যান্য বিশেষ অবস্থা (প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বন্যা-খরা ইত্যাদি) ব্যতিরেকে,
স্বাভাবিক অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়লে এদেশীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় এবং কৃষি উৎপাদন কমলে এদেশীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধি ব্যহত হয়। এটাই এদেশীয় অর্থনীতির মোজেজা- আর বাকি সব খুচড়া-খাচড়া।

ভূ-প্রকৃতি ও বাস্তুসংস্থান (Ecology) তথা প্রকৃতিগত নৈব্যর্তিক শর্তেই- এদেশে প্রাধান্যে চলে আসে কৃষি। আর প্রকৃতিগত নৈব্যর্তিক শর্ত কে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুবর্তিতায় গঠনমূলক উন্নয়ন’ই ‘টেকসই উন্নয়ন’ যা প্রকৃতি-পরিবেশ অর্থে (Ecology) বা বাস্তুসংস্থান কে রক্ষা করে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাই কৃষি ভিত্ত্বিক অর্থনীতির এদেশে- অর্থনীতির সূচকের উন্নতি ঠিক ততটাই সম্ভব যতটা সম্ভব- কৃষি ব্যাবস্থাপনা, কৃষি বিনিয়োগ, কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষি উন্নয়ন। ‘Based on Ecology’ তথা ভূ-প্রকৃতি অনুবর্তি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে- ভূমির ব্যবহার। অর্থাৎ চাষ-বাস সংশ্লিষ্টতায়- প্রকৃতি-পরিবেশ অনুবর্তিতায় বিনিয়োগ বান্ধব ‘কৃষি ব্যবস্থাপনার’ টেকসই উন্নয়ন।

সুতরাং ভূ-বৈচিত্র্যকে আমলে নিয়ে বিনিয়োগ বান্ধব "কৃষি উৎপাদনের" স্বপ্ন ভূমি  হয়ে উঠুক আগামির বাংলাদেশ।

উপস্থাপক ও গবেষকঃ

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল
E-Mail: smibrahim1986@gmail.com

লেখা পাঠাতে যোগাযোগ করুনঃ
মেসেঞ্জার অব কসমোলজি পেইজ
মেইলঃ shimul2016.bsm@gmail.com

No comments:

Post a Comment