Monday, June 22, 2020

সংগ্রামটা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে - মোঃ শামীম রেজা



এমন একটা সময় পার করতেছি আমরা যখন আমাদের বিশ্বাস, অভ্যস্ততা, মূল্যবোধ সবকিছুতেই একটা বড় ধরনের ধাক্কা লেগে গেছে। এই ধাক্কা সামষ্টিক এবং ব্যক্তি জীবনের সমগ্রব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে ফেলছে। আচার-সংষ্কার-প্রথা সবকিছুতেই শুধু ভাবনাগত  পরিবর্তনই ঘটছে না বরং ক্রম পরিবর্তনীয় এক নতুন বাস্তবতার ভিতর প্রবেশ করছি এবং এগুলোকে সহিয়ে নেওয়ার জন্য যে ধীর-স্থির বাস্তবতার প্রয়োজন সেটাও ঘটে যাচ্ছে।

একাকারের যে যুগে পৃথিবী প্রবেশ করেছিল প্রযুক্তির হাত ধরে সেটা ছিল যান্ত্রিক বাস্তবতা। প্রযুক্তির এই অগ্রগামীতার সাথে ঠিক তাল মেলাতে পারছিল না মানুষের তৈরি সামাজিক-রাষ্ট্রিক নিয়ম, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সর্বোপরি  প্রকৃতিজ সমন্বয়করণ গ্যাপটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছিল।

ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় এবং সাংস্কৃতিক বলয় থেকে উৎসারিত মানবিকতা বোধের এবং জীবন কেন্দ্রীক মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে সময় বাস্তবতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে নিয়ম-নীতি-আচার-প্রথা-বিশ্বাস। এই বিষয়গুলোর মধ্যে থাকে বিয়ে-থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর আরোপ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পর্যন্ত। খন্ডিত পৃথিবীর বাস্তবতায় (যোগাযোগের বাস্তবতা যার নির্ধারক) একেক অঞ্চলের বাস্তবতা অনুসারে নিয়ম-নীতি-আচার-প্রথা-বিশ্বাস গড়ে ওঠেছিল যা ছিল অনেকটা প্রকৃতি নির্ভর।

মানুষের প্রয়োজন বোধ এবং সেখান থেকে সৃষ্ট সন্তুষ্টি বোধ মানুষের পুরোজীবনকে গতিময় করে। এই গতি সামগ্রিক জগত-সংসারে কতকিছু যে সৃষ্টি করে ফেলতে পারে তার উদাহরণ মানব-সভ্যতার ইতিহাস।
আধুনিক অর্থনীতি শাস্ত্র মানুষের এই সন্তুষ্টিকে অর্থনীতিকরণের মাধ্যমে তার রূপরেখা এবং সংজ্ঞা বাতলে দিয়েছেন এবং তার উপর ভিত্তি করেই ভোক্তা আচরণ কেমন হলে বাজার চাঙ্গা থাকবে সে বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা চলেছে এবং চলে। তো সন্তুষ্টি বোধের সাথে মানুষের চেতনাবোধের এবং সংস্কারের ত্রিমাত্রিক সমান্তরাল একটা সম্পর্ক রয়েছে।

উপযোগিতা হলো অর্থনীতির ভাষায় সন্তুষ্টি। সাধারন অর্থে সন্তুষ্টি বলতে যা বোঝায় অর্থনীতির সন্তুষ্টি একটু ভিন্ন।

তো কেমন সে সন্তুষ্টি?

কোন পণ্য বা সেবা বা ঘটনাসমূহ থেকে উদ্ভূত যা ব্যক্তিকে সন্তুষ্টি দিতে সক্ষম তাকেই ঔ পণ্যের উপযোগিতা বলে। এই উপযোগিতার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটা হলো "উপযোগ  মানসিক ধারণা"। আরেকটি হলো "উপযোগের ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার বিষয় বিবেচিত হয় না"।
উপযোগ হলো সন্তুষ্টি। এই সন্তুষ্টি হলো ভোক্তার। পক্ষ হলো দুটো, পণ্য এবং ভোক্তা।

ভোক্তা তো স্বয়ংক্রিয় কোন স্বত্ত্বা নয়। ভোক্তা একজন ব্যক্তি। তো ব্যক্তির উৎপত্তি, কর্মবলয়, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক সম্পর্কসমূহের কেন্দ্রে থাকেন ঔ ব্যক্তিটি। এমন করে প্রত্যেকটি ব্যক্তিই এক একটা কর্মকান্ড এবং সম্পর্কের কেন্দ্র এবং প্রত্যেকটা ব্যক্তিই মহাকালের মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থান করে তার সাপেক্ষে।

তার পিছনে থাকে লক্ষ বছরের বিগত ইতিহাস আর সামনে থাকে অনাগত মহাকাল। ব্যক্তির জীবন থেকে উৎসারিত বোধ এবং সেই বোধের প্রয়োগই যাপনে প্রতিফলিত হয় (তবে সেটা সাধারন অর্থে সমাজ, রাষ্ট্র বিধি মেনে)।

ব্যক্তি কে?

ব্যক্তি হলো একটা বোধ স্বত্তা।

বোধ কি স্বয়ং গড়ে উঠে?

বোধ গঠিত হয় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচিত মানদন্ড অনুসারে। শিশু জন্ম নেওয়ার পর ব্যক্তি হয়ে উঠতে থাকে। বিনির্মাণ হতে থাকে তার পরিচয় সমূহ। এইসব পরিচয় তার আইডেন্টিটি তৈরি করে সে নিজে থেকে এই আইডেন্টিটি তৈরি করতে সক্ষম নয়। এই আইডেন্টিটি বস্তুজগত এবং অবস্তুজগতের সাথে তার কিরূপ সম্পর্ক এবং সম্পর্কজাত ক্রিয়া কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় সময়ের সাপেক্ষে।

মানুষ হওয়ার শর্তগত কারণেই ব্যক্তি সমাজ থেকে প্রাপ্ত এই আইডেন্টিটি কে একসময় মাড়িয়ে যেতে সক্ষম সাংস্কৃতিক অভিযোজনের কারণে এবং মাড়িয়ে গিয়ে বিনির্মাণ করে নিজের মনুষ্যত্ব বোধের ন্যায়দন্ডে নতুন দিনের নতুন পরিচয়। একই সাথে খোলনলচে পাল্টে ফেলতে পারে জীবন কেন্দ্রীক যাবতীয় প্রচল মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি। সফলতা-বিফলতা সুখ-শান্তি-মুক্তি এই সব জীবনের সার সূচক গুলো যে রঙে তাকে সমাজ-পরিবার -রাষ্ট্র রাঙিয়ে দেয় তার মনের আকাশ জুড়ে একদিন সেই সব রঙকে মিথ্যা ঘোষণা করে বেরিয়ে পড়তে পারে। তার উদাহরণ ইতিহাসে আছে।  সন্তুষ্টি বোধের ধারণা ব্যক্তি নির্মাণ করতে পারে যদি ব্যক্তি সামষ্টিক হয়ে উঠতে পারেন। অন্যথায় ব্যক্তির বোধের সাথে ব্যক্তিবোধের রূচিগত সমাজতাত্ত্বিক তেমন কোন ভিন্নতা নাই।

ব্যক্তির সন্তুষ্টিবোধ গড়ে ওঠে এই বস্তুগত এবং অবস্তুগত সম্পর্ক ক্রিয়া থেকে। সন্তুষ্টি প্রাপ্তির জন্য যে ক্রিয়াদি ব্যক্তির করতে হয় সেসব ক্রিয়ার যদি লেনদেন এবং বাজারী মূল্য না থাকে তো সেই সন্তুষ্টি অর্থনীতির সন্তুষ্টি নয় এবং সেসব কর্মসমূহকে ইরেশনাল বিহ্যাভিয়ার বলে গণ্য করা হয়। রেশনাল এবং ইরেশনাল মানুষের সাধারন এবং স্বাভাবিক মান বিচারে নিযুক্ত দুটি শব্দ। যখন ইরেশনাল বলা হয় তখন সেটা মানুষের সাধারন বৈশিষ্ট্য থেকেই খারিজ করে দেওয়া হয়। 

ব্যক্তির সন্তুষ্টি বোধ কোথা থেকে আসে? কিভাবে গড়ে ওঠে সন্তুষ্টি বোধের সংস্কার? পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তথা পারস্পারিক সম্পর্কজাত হয়ে তথ্য বিনিময় এবং গড়ে ওঠা অভ্যাসের মাধ্যমে। এমনকি খাদ্যের যে স্বাদবোধ বা নান্দনিক বোধ সেটাও তো ঔ পরিবার-সমাজ-তথা সংস্কৃতি থেকেই প্রাপ্ত হয়।
ব্যক্তি দুটো পদ্ধতিতে আত্মীয়করণ করে তার স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র এবং আচরণ গড়ে তোলে। অভ্যস্তকরণ এবং দীক্ষিতকরণ। অভ্যস্তকরণ প্রক্রিয়ায় থাকে ব্যক্তি এবং বস্তগত ঘটনাবলির সাথে সার্বক্ষণিক মিথস্ক্রিয়া, আর যে মাধ্যমে সে সংযোগ স্থাপন করে তা হলো দীক্ষিতকরণ। দীক্ষিতকরণ প্রক্রিয়ায় তথ্য হয় প্রধান এবং মৌলিক শর্ত। একজন পাকা কৃষক মাটি দেখলেই বুঝতে পারেন কখন বীজ বুনতে হবে। এটা তার পূর্ব অভিজ্ঞতাজাত শিক্ষা, শুধু তথ্য নয়। ব্যক্তির ভিতরে আগমনকারী সব তথ্যই শিক্ষায় রূপান্তর হয়না। দীক্ষিতকরণ এই কাজটা করে কোন তথ্যকে শিক্ষায় রুপান্তর করতে হবে সেটা সে নির্ধারন করে নেয় এবং ঔ মোতাবেক ব্যক্তির ভিতর কাজ চালাতে থাকে।

সন্তুষ্টিবোধ স্বয়ং ব্যক্তির ভিতর হাজির হয় না এটা সমাজ-সংস্কার থেকেই আসে। সমাজ সংস্কার তৈরি হয়, সন্তুষ্টিবোধ স্বয়ং ব্যক্তির ভিতর হাজির হয় না এটা সমাজ-সংস্কার থেকেই আসে। সমাজ সংস্কার তৈরি হয় সেই সমাজের উৎপাদন এবং বন্টন পদ্ধতি এবং জগত ও শরীর মনের সাথে তার যে নিত্য সংযোগ সেই সংযোগের সম্পর্ক বিবেচনার উপর।
একটা হিংস্র বাঘ কেবল অভুক্ত থাকলেই শিকারে প্রবৃত্ত হয় কিন্তু মানুষ! মানুষের এই লোভ সভ্যতায় সৃজনশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। মানুষ মানবিকতার সীমা রেখে টেনেছে স্বজাতীর স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে, বিভাজনের প্রাথমিক এই বলয়টা ভেঙে ফেলা দরকার। এরপর মানব সমাজে রাষ্ট্র, লিঙ্গ, ধর্ম, নীতি, অর্থ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিভাজন এবং ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে যে পদ্ধতিতে জ্ঞানকান্ডের শাখা-প্রশাখা বিস্তার হয়েছে তা একেবারে গোড়া থেকে ছেটে ফেলার সময় হয়েছে।

রক্তজ প্রবণতায় আদিমতা, বিভাজনে দাসসুলভ, প্রভুত্বে সামন্ততান্ত্রিক এবং স্বার্থপরতায় পুঁজিবাদী চেতনার আকর সমূলে উৎপাটন করার সময় হয়েছে। জীবন এবং জগতকে ঘিরে যে মূল্যবোধ এবং সেই মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে যে মর্যাদাবোধ তা যদি মনুষ্যত্ব ও মানবিকবোধ উত্তীর্ণ হয়ে প্রকৃতজ স্বত্ত্বায় একাকার না হতে পারে একাকারের এই মহাক্ষণ মানব জাতীর জন্য মঙ্গলজনক হয়ে ওঠবে না।
সংগ্রামটা তাই মানুষ হওয়ার মর্যাদায় আত্ম-অমানবিক প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে।

২২.০৬.২০২০

No comments:

Post a Comment