Wednesday, June 3, 2020

পরীক্ষায় ফেল অথবা আত্মহত্যা অথবা খুন হয়ে যাওয়া সম্ভাবনা সমূহ - মোঃ শামীম রেজা


এস এস সি বা এইচ এস সি বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর যখন পত্রিকাতে শিরোনাম দেখি কোমলমতি বাচ্চাদের আত্মহত্যার  এবং একই সাথে নাম করা স্কুল ও সেরা কিছু শিক্ষার্থীদের ছবি ছাপা - দুটো খবরই আমার কাছে সমানভাবে দুঃখজনক এবং অশ্লীল। প্রথম ঘটনাটার জন্য সামষ্টিকভাবে দ্বিতীয় ঘটনাটার কোন না কোন ভাবে দায় আছে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি? কেন ছেলে মেয়েদের কে শিক্ষিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়?

একসময় বলা হতো মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদেরকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়।

আজ স্কুল -কলেজের গন্ডিতে যাওয়ার পর তারা প্রথম যে বিষয়টা জানতে পারে তা হলো তাকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করা হয়েছে এবং তাকে সর্বোচ্চ জায়গাটাতে যেতে হবে নইলে তার পরিবারের এবং তার নিজের জীবন ব্যর্থ। এই যে মূল্যবোধ তার বীজ বপন করে দেওয়া হলো পরিবার এবং প্রতিষ্ঠান থেকে। এই বোধের সুদুরপ্রসারী ফল ফলতে থাকে সমাজ-রাষ্ট্র -পরিবারে।

কিভাবে?

এই শিক্ষার ফলে তার ভিতরে গড়ে ওঠে আমি আমি ভাব। জীবনের সর্বক্ষেত্র জুড়ে এই ভাবের চাষ হতে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম যে নাই তা নয়। সফলতার ব্যর্থতার মানদন্ড তাকে নিয়ে যায় এক নিরন্তর আমিময় আকাঙ্খার ভিতর যেখানে সামাজিক দায়বোধ থাকে না, রাষ্ট্রিক দায়বোধ থাকে না, এমনকি একসময় দেখা যাবে সে বৃদ্ধাশ্রমের মত দায়হীন অমানবিক ব্যবস্থার পক্ষে কাজ করছে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গুরু দ্রোণের পিতৃস্নেহের দুর্বলতা এবং পুত্রের সুখ ভাবনা থেকে যে ভুল শিক্ষা অশ্বথামা পেয়েছিল সেই শিক্ষা পরবর্তীতে পুত্রকে পিতার অবাধ্য হওয়ার ইন্ধন যুগিয়েছিল। অপরপক্ষে নিজেদের শিক্ষা গুরু শত্রু পক্ষে থাকা স্বত্ত্বেও পান্ডুপুত্রগণ শিক্ষা গুরুর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে সবসময়।

এর কারণ কি?
কারণটা হলো পান্ডবপুত্রগণ মনে করেছে যে, এটা ন্যায়ের যুদ্ধ ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ সামষ্টিক কল্যাণের জন্য এই যুদ্ধের প্রয়োজন হচ্ছে। এখানে সামষ্টিক বোধ হলো মূখ্য বিষয়।

এ কালের শিক্ষা ব্যবস্থা তো কোমলমতি শিশুদের যন্ত্র ছাড়া আর কিছু বানাতে পারছে না, সামষ্টিক বোধ নির্মাণ তো দুরাশা। আমাদের দেশে তো এখন দু-তিন বছরের শিশুকে যন্ত্র বানানোর কারখানায় নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছে।

এই সময় থেকেই তার ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সে একা এবং জগত সংসারে তাকে সফল হতে হলে ভালো ফলাফল করে অমুক-তমুক হতে হবে। এর বাইরে যে বিশ্বপ্রকৃতি আছে, সমাজ আছে, রাষ্ট্র আছে, মানবিকতা আছে, সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের প্রতি যে তার একটু হলেও দায়বোধ আছে তার কোন শিক্ষাই তো সে পায় না। এক সময় নিজের ভিতর আটকে গিয়ে এতোটাই ইগো, আত্মকেন্দ্রীকতায় ডুবে যেতে হয় - বাবা মায়ের সাথেও হিসেবী হয়ে উঠতে হয় তাকে।

বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইউরোপীয় আলোকায়ন প্রাপ্তীর এই হলো সমাজতাত্ত্বিক ফল। এর বাইরে যে অংশটা আছে তারা তো দেশের বাইরে উড়াল দেয় আর একেবারে প্রান্তিক তাদের খাবি খাওয়া শিক্ষা দিয়ে কোনরকম উঠতি কলকারখানা গুলোয় শ্রমের যোগান দেয়।

শিশু বয়স থেকেই যে মানদন্ড একজন শিশুর মূল্যবোধে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তখন সেটাই তার জীবনের সারৎসার হয়ে দাড়ায়। সেখানে ব্যর্থ হলে জীবনের আর কোন মানে থাকে কি?


এর বাইরে যে অংশটা থেকে যেতে চায় বা এই ব্যবস্থাকে মানতে চায় না, তারা নেশাগ্রস্ত অথবা উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের স্বীকার হয়। যার কোনটার জন্যই সে কোনভাবেই দায়ী নয়।

বড় মানুষ হওয়া বলতে পেশাভিত্তিকতার যে দাওয়া দেওয়া হয় তার ফল সফলতায় এবং বিফলতায় উভয়টাতেই সমাজ রাষ্ট্রের জন্য অস্বাস্থ্যকর।

বড় মানুষ মানে বড় চৈতন্যজগতের অধিকারী মানুষ। যে চেতনায় মানবিকতা-মনুষ্যত্ব বোধের শিক্ষা আসে না, সেখানে জীবনকে অতি তুচ্ছ কারণে যেমন খুব বড় বা আরামদায়ক মনে হতে সময় লাগে না আবার অতি তুচ্ছ কারণে খুব ছোট বা যন্ত্রনাদায়ক মনে হতেও সময় লাগে না।

বিগত দশ বছরে ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু বিগত দশ বছরে সামাজিক -রাজনৈতিক মান কোন দিকে ধাবিত হয়েছে?

যেসব শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে কিংবা  করছে তারা কি এই শিক্ষা-সমাজ মূল্যবোধের বলি হলো না?


 অনেকেই বলছেন টলছেন যে, ছেলেমেয়েদেরকে সময় দিন, তাদেরকে খেলাধুলা করতে দিন। সময় দেওয়া বা খেলাধুলা করতে দেওয়ার বিষয়! ভাবুন অভিভাবক হিসেবে আজকের বাবা মা-শিক্ষকদের অবস্থাটা কোন স্তরে যে একজন শিশু তার বাবা-মা'র কাছ থেকে সময় পাওয়া উচিত, তার খেলাধুলা করা উচিত, এটা জানার জন্য বা বোঝার জন্য মনরোগ বিশেজ্ঞদের কাছে যাওয়া লাগছে!

আসলে মন বিকল কাদের হয়েছে?

কিন্তু এমনটা কেউ তো বলছেন না যে সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার দায় আছে এবং সেই দায়ে দীপ্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সাথে মানবিকতা অর্জন করতে হবে। যে যে বিষয়ে তার আগ্রহ হয় সে বিষয় নিয়েই সে পড়ালেখা করুক মানুষকে ভালোবেসে। তো সে ভালো ফলাফল করে বড় চাকরি করে ঘুষ খাবে না, দুর্নীতি করবে না তো কি আঙুল চুষবে? আর সেখানে যদি এস এস সি বা এইচ এস সি তে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায় পরিবার এবং সামাজিক স্ট্যাটাস অনুযায়ী তখন আত্মহত্যায় তো তার মুক্তির পথ, নাকি!

সর্বোপরি একটা কথা বলে শেষ করতে চাই
কুয়োতে যা থাকে বালতিতে তাই উঠে আসে।
কি শিখছে আজকের ছেলেমেয়েরা তা অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে, তার আগে তাদেরকে পরিষ্কার করতে হবে কেন শিখবে তারা। নইলে আগামীতে আরো বিকৃত এবং অমানবিক অনেক কিছু দেখার জন্য প্রস্তত থাকতে হবে।

হয়তো এই সব ঝরে পড়া বা সমাজ ভাষায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে গুলোই বিপুল সম্ভাবনাময় ছিল তাদের ক্ষেত্রজুড়ে। উপযোগী পরিচর্যা এবং প্রকাশের মাটি না পাওয়ায় তারা বিকশিত হতে পারেনি।

বিঃদ্রঃ অমুক রিকশা চালকের ছেলে, তমুক দিন মজুরের মেয়ে একবেলা দুবেলা খেয়ে এরাম ওরাম রেজাল্ট করছে এগুলো এভাবে ছাপতে আপনাদের রুচিতে বাধে না?

০৩.০৬.২০২০

No comments:

Post a Comment