Tuesday, August 11, 2020

আমাদের স্যার এখন টিচার হয়ে গেছে - মনীষা মোহাম্মদ।

   

মেসেঞ্জার অব কসমোলজি

আমাদের স্যার এখন টিচার হয়ে গেছে

তখন প্রাইমারী। হেডস্যার কাকার সাথে দেখা করতে এসেছেন। খুব সম্ভবত স্কুলের কোন মিটিং প্রসঙ্গে। আরও দুজন মুরুব্বি পাশেই বসা। আলোচনা চলছে। স্যার এসেছে শুনে আমি দেখা করতে গেলাম। যদিও তখন স্যারদের সামনে পড়া মানে নিজে একটা ভেড়া হয়ে যাওয়া। রাস্তায় স্যারকে দেখে সাইকেল থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে সাইকেল পাগাড়ে গেলে হাতে পায়ে ব্যাথা, সাথে স্যারের "ওই গাধা তোরে নামতে কইছে ক্যাডা?" বলে বকাঝকা। আর সাইকেল থেকে না নেমে সালাম দিলেও " কিরে বেক্কল, সাইকেলে থেকেই সালাম দেয়?" বলে বকাঝকা খেতেই হতো। গাধা কিংবা বেক্কল সেজে মাথা নিচু রাখা ছাড়া উপায় থাকতো না। তখনকার স্যারেরা এখনকার মতোন টিচার ছিলেন না। কন্ঠ উঁচু করে বলা যেতো না, টিচার আবার বুঝান। না বুঝলে বোকা বোকা চেহারা নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। স্যার কাছে এসে বলতেন, কীরে বোকার দল, এখনো বুঝস নাই? সেই সব দিন গুলো অন্য রকম ছিলো। স্যারদের কথা গুলো ছিলো পবিত্র বাক্যের মতোন। এখনকার টিচারদের মতোন, স্যারদের গাঁয়ে প্রচলিত বড় ভাই, বড় ভাই গন্ধ ছিলোনা। বেশি কিছু ছিলো। অক্ষর না চেনা মা স্যারদের সম্পর্কে বলতেন- বাপ মা বানায় ভূত, স্যারে বানায় পুত। একথা শুনেছি স্কুলে যাবার আগেই। কথাটির মর্ম তখনো বুঝি না। কিন্তু কথাটা মন্ত্র বাক্য হয়ে মাথায় সেঁটে থাকতো। এখন যে কী দিন আইলো!

যা বলছিলাম। স্যার কাকার সাথে কথা বলছিলেন। আমি কাকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, সালাম দেবোকি দেবোনা। আলাপ কালে পাশ থেকে কথা বলা ঠিক নয়। পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। আলাপের মধ্য বিরতিতে কথা শুরু করতে হয়। বাবা শিখিয়েছেন। কিন্তু স্যারকে দেখে প্রথমেই সালাম দিতে হবে এটাও বলেছিলেন। পরে বুঝেছি সেদিন যে অবস্থায় ছিলাম তার নাম উভয় সংকট। যা হোক, আমি ছোট করে সালাম দিয়ে দিলাম। কন্ঠ স্বর হয়তো কাকার কান পর্যন্তই পোঁছেছিলো। দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর কথা থামিয়ে স্যার বললেন, এই শিখাইছি? সালাম দেওয়াও ভুলে গেছস? উত্তর করার শক্তি সে সময়ের কোন ছাত্ররই নেই। বোকা হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। টেকনিকটা কাজে লেগেছিলো সেদিন। কাকা পক্ষ নিয়ে বললেন- স্যার, ছোটতো, ঠিক বুঝতে পারেনি। তবে আস্তে করে সালাম দিয়েছে। কাকার কল্যাণে শেষ রক্ষা হলো সেদিন।

হেডস্যার মাঝে মাঝেই একটি গান বলতেন, এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিয়ে যাবো সে দিনেরও কাছে। পুরোটা মনে পড়ছেনা। খুব ভালো লাগতো স্যারের কন্ঠে। নিহিত অর্থ তখোন জানতামনা। এখনো ঠিক জানিনা। তবে বুঝি দিনকে এগিয়ে নিতে হয়। নইলে দিন ব্যাকডেটেড হয়ে যায়। ডেটএক্সপায়ার্ড।

দীর্ঘদিন হলো স্যারের সাথে দেখা নাই। দেখা হলে এবার গাধা কিংবা বোকা নয়, অপরাধী হয়ে মাথা নিচু করে রাখতে হবে। দিনকে আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি। বরং স্যারদের যে দিন ছিলো তাকে এলোমেলো করে দিয়েছি। নষ্ট করে দিয়েছি ছাত্র শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্ক। মোনাফেকের মতোন মুখে মুখে দিন এগিয়ে নেবার শিক্ষা গ্রহণ করেছি। দিনকে এগিয়ে না নিয়ে গিয়ে আমরা বরং স্থবির করে দিয়েছি। স্যারের পবিত্র শিক্ষাকে কলঙ্কিত করেছি।

দিন কেমন করে বদলে গেলো। চোখের সামনেই সব নষ্ট হয়ে গেলো। পুরাদমে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হলো। নৈতিকতাকে ডাস্টার দিয়ে মুছে দেওয়া হলো। বয়সের ভারে স্যার এখন হয়তো দেশ দুনিয়ার সব খবর জানেন না। স্যার হয়তো জানেন না তাঁর ছাত্ররা পেয়েছে পশুর আকৃতি। মানুষ হয়ে ওঠেনি। জানলে স্যার কী বসে বসে কাঁদবেন? স্যার কী ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? আমি যদি বলি, স্যার, আপনারা এখন তথাকথিত বড় ভাই হয়ে গেছেন; স্যার কী আমার কানমলা দিবেন নাকি কোন জন্তু ভেবে চুপচাপ তাকিয়ে থাকবেন?

তখন আমি প্রাইমারী, আজ পিতা। তখন আমার মা অক্ষর চিনতো না, এখন বাবুর মা এম এ। তখন বাবা মেট্রিক, আজ আমি এম এস সি। দিন কত ভাবে বদলে গেছে! শুধু এগিয়ে যায়নি। এখনকার মায়েরা স্কুলে যাবার আগে কোন মন্ত্র বাক্য শেখান? এখনকার টিচারেরা কোন বাক্যকে জীবনের মন্ত্র ভাবেন?

সেই দিন গত হয়েছে। আজ সব কিছুই বাণিজ্যিক জলে ভেসে গেছে। পিতা মাতা, শিক্ষক শিক্ষিকা, মুরুব্বিগন সবাই বাণিজ্যিক জলে হাল ধরেছেন। সেদিনের সেই স্যারদের মুখোমুখি হলে আজ বোবা হয়ে ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় নেই। তাঁরা জীবনাচার দিয়েই আমাদের মানুষ করতে চেয়েছিলেন। আমরা হয়ে গেছি পশু। আমাদের অনুজরা দ্রুত বর্ধনশীল পশু। পতন ফেরাবার  কেউ কী নেই?

মহান স্রষ্টা এপাড়ে ওপাড়ে স্যারদের দিন সুমহান মর্যাদা।


১২.০৮.২০২০



লেখা পাঠাতে যোগাযোগ করুনঃ

মেসেঞ্জার অব কসমোলজি পেইজ এ 

No comments:

Post a Comment