অন্যপাতা

Sunday, July 26, 2020

শামীম রেজার কবিতা গুচ্ছ - যে পথে আলো আসে।

বৌদ্ধিক ডুবারু কবি একদম ডুব দিয়েছেন বোধের অতল গহ্বরে। তুলে এনেছেন মণিমুক্তা, পান্না সব। এ সমস্ত মূল্যবান পাথর গুলোই যেন এক একটি শব্দ। আর কবি নিজে সে সমস্ত শব্দ জুড়ো দিয়ে গেঁথেছেন বৌদ্ধিক প্রতিমা। মূলত সে প্রতিমাই কবিতা গুলো। একবার চোখ মেলে তাকালে, তাকিয়ে থাকলে, যেন খোঁজে পাবেন আলো; প্রতিমার গাত্র নিঃসৃত। আলোর ঝলকানিতে আপনার চিরায়ত অন্ধত্ব বিদূরিত হবে। ভাবনার নতুন দিগন্তে খোঁজে পাবেন আপনাকে।
 
 

প্রকাশক : মেসেঞ্জার অব কসমোলজি। 
প্রকাশ    : জুলাই, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।
উৎসর্গ    : তাকে।

যে পথে আলো আসে


প্রশ্ন থেকে আলো


আছড়ে পড়ে শব্দগুলো
মস্তিষ্কের কোষে কোষে
টের পাই মস্তিষ্কজীবী
বুক তার এখনও বেচে আছে
পালসগুলোকে অস্বীকার করে তৃতীয় স্বত্ত্বা
মুচকি হেসে বলে
আয়নায় চোখ রাখ

আশ্চর্য আয়নার কোথাও কোন ক্ষত নাই
দাত নখের ছাপ আছে
মধ্যরাতে নিজেকে খুলে-পাল্টেছে-সাজিয়েছে-রাঙিয়েছে
কত বেসাতি পোষ্য-অপোষ্য গৃহস্থালি।

চে শার্টের কলার থেকে ঘাম রক্ত রক্ত
সেই রক্তে নিজের ছবি আকতে গিয়ে আতকে উঠি
দেখি খন্ড-বিখন্ড ছায়া ক্ষরিত আদিম উপত্যকা
লালন মঞ্চে বিজিত কলিঙ্গ সম্রাট
দ্বন্দ্বমুলক বস্তুবাদ গুনতে চাই
অথচ ক্রুশেড কেন হতে পারে
তখনও জানে না হাড়িরাম সম্প্রদায়।

প্রতিফলনের সামনে একটা ঘোমটা পড়া কলাগাছ দেখি
কলাগাছটা দেখছে একজোড়া গজদন্ত।

প্রথম পুরুষ প্রশ্ন করতে ভুলে যায়
দ্বিতীয় পুরুষ ভুলে যাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে
প্রকৃতির অংশজ আবিষ্কার হেতু প্রশ্ন করতে উদ্যত তৃতীয়জন
এবং অবশ্যই প্রশ্ন থেমে গেলে সুখি হয় মানুষ

উত্তর জন্মের প্রেতাত্মা হয়ে ঘোষণা করি ভালো আছি
সমাজ রাষ্ট্র আর কতটুকুই বা বাস্তুক।

বোধের তৃতীয় নয়ন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যা দেখেছে
তাকে নিত্য অবিনশ্বর বলে।
বস্তুত আলো কখনই প্রবঞ্চক হতে পারে না
প্রশ্নের গর্ভজাত আধারের বুক ফেড়ে নিজ স্বরুপ উন্মোচন করে।

ভালো থাকার শর্ত প্রশ্নের পাটাতন থেকে উৎসারিত হয়
সমগ্র চরাচরে।
এবং নির্লিপ্ত ভালো থাকা
নিজেকে নির্লজ্জের মত বলে ফেলে ভালো আছি
বেহায়ার মত কপটতা করে বলে
আপনি কেমন আছেন।

যেভাবে খুন হয় আমাদের মায়ের ভোর পাখি

আমি আগুন হতে পারিনি বলে আমার পিতা হাপড়  হতে পারিনি
ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানে
অনুমিতি মান হিসেবে
পিতাকে ক্ষুদ্রশিল্পী  ধরা হয়েছে বার বার।
অতিশুক্ষ্ম হৃদয় কোণে ঠিকই
তাকে পুরুষের বিজয় কেতন
উড়াতে দেখেছি পরাজিত সভ্য ভাগাড়ের উপর।

দেখো জুলিয়াস সিজার
আমাদের বুক তবুও কয়লা শিল্পে কেমন রাঙা হয়ে ওঠে দিনান্তে

কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে আমাদের মা শীতল জলের ন্যায় পড়ে থাকে
গৃহস্থালির কায়কারবারের আপাদমস্তক জুড়ে
আমাদের মা কে কখনও বেহুলা হতে দেখিনি
কিন্তু তাকে ভাসতে দেখেছি
ভাসতেই দেখে যাচ্ছি।

ক্লিওপেট্রা একে আপনি ক্ষুদ্র মহান লৌহ শিল্প বলতে পারেন।
লোহার ডাল সিদ্ধের কাজটা আপনি কখনও করেছেন?
জানেন কোন ছিদ্র বন্ধ করলে ফুটো কলসিতেও জল বয়ে আনা সম্ভব?

আমাদের যৌবনকালে বাবা লাল রঙা নরম লোহার গল্প শুনিয়েছেন
আর মা শুনিয়েছেন ভোরের পাখিদের নীড় ছেড়ে যাওয়ার শব্দ।
পাখিদের শব্দে আমাদের হৃদয় ক্ষণিক ব্যাকুল, মোহিত থাকলেও
আমাদের চোখে থাকে ছিটকে পড়া আগুনের ফুলকি,
হাত শাসিত থাকে কোন পূর্ব-নির্ধারিত আদলে,
ফলে মায়ের শোনানো ভোরের পাখি আত্মহত্যা করে
নীড় থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরপর।
প্রতিদিনই এমন হত্যা দিয়ে শুরু হয় পৃথিবীর ভোর।

আমাদের মা বুকের হাড় পুড়িয়ে জীবনের জ্বালানি হয় রোজ
আর আমরা হয়ে উঠি বাবার হাতের সান দেওয়া অস্ত্র
যা দিয়ে আমাদের পুরুষ বাবা খুণ করে আমাদের
মায়ের ভোরের পাখি।

বিপ্লব ও কবিতা 

আজ অব্দী একটা প্রেমের কবিতা লেখা হলো না।
বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর থাকা মানুষ অপ্রেমে থাকতে পারে?
কেমন বিপ্লবী তুমি কবি?
ঘাতকের মতো কেবল ওতপেতে বসে আছো
সুযোগে সওয়ার হয়ে খুণ করবে অপ্রেম যাপনকে
তাতে উল্লাস মিলবে
প্রেম ধারা দিবে কি?
ঔ শোন ধরাশায়ী জীবনের প্রলাপসমূহ যারা প্রেমের নামে জীবনকে চিনতে গিয়েছিল
ছদ্মবেশী বিপ্লব যাদের প্রেমকে ছুতে পারিনি
একবার জীবন থেকে বিচ্যূত হয় তো আরেকবার প্রেম থেকে।
আধুনিকতার ঘোর তোমার  এখনও কাটেনি কবি
তাই ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য র নোংড়া ঘুলঘুলিতে হারিয়ে ফেলছো গন্তব্যের খেই
এ মাটি তো প্রেমের কথা বিপ্লবের মুখে বলে
শিকড় পৃথকীকরণ বিদ্যা নিয়ে তুমি গাছ বাচানোর বিদ্যা ফলাতো এসেছো কবি!
কিন্তু অনায়াসে বৃক্ষদের দুঃখ নিয়ে রচে যেত পারো দিস্তার পর দিস্তা কবিতা
তাতে কি বৃক্ষের প্রেম থাকে?
বিপ্লব থাকে?
প্রেমহীন বিপ্লব আর বিপ্লবহীন প্রেমের প্রয়াস
উচ্ছিষ্ট সম্পর্কের ছিনালীপনা ছাড়া আরকি?
ওতে সাময়িক তুষ্টি মেলে বৈকি
স্বস্তির হদিস মেলে কি?
এর বাইরে আসেন ঘাস-লতা-পাতার কীর্তনে কাটায় জীবের বাদবাকি আর্তি।
প্রেমের কবিতা মেলে না
মেলে না বিপ্লবের কবিতা
অথচ দুনিয়াতে প্রেমের বিপ্লব খুব প্রয়োজন
বিপ্লবে প্রেম খুব দরকার
আমরা কেবলই বিভক্ত হচ্ছি
আমি কেবলই বিভক্ত হচ্ছি প্রেম থেকে বিপ্লবে
বিপ্লব থেকে প্রেমে
অথচ তারা অবিচ্ছেদ্য শর্তে থাকে জগতের আগামীর প্রশ্নে
কবি তুমি কোন শর্তে?

প্রতিবিম্বে এক চক্র

আমাদেরই মারা গিটগুলো যখন ফাস হয়ে টান দেয় আমাদের গলা
অবশ্য যাদের গলা নেই আছে জিহ্বা আর আছে অদৃশ্য বন্দিত্বের স্বাধীনতা
বিপক্ষে গেছে তারা
এই যে গিট আর তারা মিলে হয়ে গেছে অবিনশ্বর

সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তি র বলয় বিভক্তের মোহে হয়ে গেছে দীর্ন
প্রেম অথবা প্রার্থনা অজস্র বলয়ে হয়েছে বিচ্ছিন্ন
ফলত অখন্ড পাটাতন পায়নি আমাদের দ্রোহ অথবা ভালোবাসার ক্ষেত্র
কি এক মহা বিরহের সারথী হয়ে ক্ষুধা আর অন্যয্যতার চক্রে আবর্তিত হয়েছে
আমাদের পবিত্র রক্তের বলি
এ যে মহাকাল থেকে মুক্তি না পাওয়া তাদের
অর্থাৎ সেই সব ঈশ্বরীয় হল্লার রক্তজ হোলি
শরীর থেকে শুষে যাওয়া রক্তের উপর দাঁড়িয়ে প্রজন্মান্তর
স্বপ্নের ভিতর  হারিয়ে ফেলা পুনরাবৃত্তিক পথে

সভ্যতা বুননের ঊষাকালে তুমি আমি আমরা
প্রত্যয়ের কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলাম
অনাগত ভবিষ্যৎকে চুম্বন করে
আমাদের ঠোটে পেরেক ঠুকে দিয়ে সে
আজ অঞ্জলি হয়ে গেছে প্রেতপুরী র
আমাদের ভাষা হারিয়েছে প্রকাশ ক্ষমতা এবং অর্থবহতা
দীর্ঘ অমানিশার ভিতর জাপটে ধরতে গিয়ে দেখি
বহুপথ ঘুরেফিরে কত শত অনুসন্ধান শেষে
ধুকছে তোমাদের ছায়া
এই ঐতিহাসিক চক্র থেকে বের না হতে পারা তুমি তোমরা
অথবা আমি আমরা
দ্বিপক্ষীয় হয়ে যায় বারবার
অভীষ্ঠতার শর্তে আমাদের তৃষিত লক্ষ্য
প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি
কেবল যোজন দ্বিধা আর ঐতিহাসিক ভ্রুকুটি
শাসন করে আমাদের দুরত্ব
ব্যবধানের গৌরবে আমরা হয়ে উঠি
একেকজন তপস্যাস্নাত শয়তান। 

নিশিতা

জন্মের বিহ্বলতাই জেরবার হয়েছি বারংবার
অসংখ্য ঘুম ভাঙা রাত ফুপরে খুজেছে হাসনাহেনার ঝরেপড়ার সঙ্গ
বিভঙ্গের দহনে মুখ গুমড়ে পড়ে থাকে অপেক্ষার সকাল
তারপর ভোরের স্বপ্ন ডানা মেলে উড়ে গেছে নীল পাহাড়ের দেশে।
পাথুরে পাহাড়ের বুক ভেঙে বের হয়ে আসা জলের স্ফটিক বলে গেছে
নিঃসঙ্গতার কি স্বচ্ছ শান্ত আর্তনাদ থাকতে পারে।
দ্বিধায় উথলে ওঠা অভিমানের বলক
ভীরু সংশয়ের পাড় ভাঙতে পারিনি
বরং গন্ধকের চূর্ণ হয়ে মিশে গেছে বহ্নিমান হৃদয়ের শোণিতে।

এইবার বুঝি রাতজাগা ফসলের গান গাইবে ঘুমিয়ে থাকা অনাবাদী নিস্ফল ভুমি

জন্মের অর্থ কি জানো নিশিতা?
দ্রোহ, প্রেম আর বিপ্লবে
রাতের সংশয় আর বিহ্বলতা পেরিয়ে নিশ্চয়
আমরা একটা ভোর পাবো পেয়ে যাবো
মনে রেখ এ পৃথিবী মানুষের হবে।
আর আমরা সেই স্বপ্নে চলো বাকিটা রাত পেরিয়ে
যাই মহাকালের আহ্বানে। 


লেখা পাঠাতে যোগাযোগ করুনঃ 
 পেইজ : মেসেঞ্জার অব কসমোলজি
মেইল : shimul2016.bsm@gmail.com

No comments:

Post a Comment